Saturday, December 1, 2018

পিনাকী বসু



গল্প-
ভাইফোঁটা

ভাইয়ার ঘুম তো নয় ,যেন কুম্ভকর্ণ |অত রাত করে শুলে কেউ সকালসকাল উঠতে পারে  ?যতক্ষণ না তার মোবাইলের চার্জ শেষ হচ্ছে ততক্ষন সে শোবে না |
সেই কোন কাকভোরে  উঠে ,ঘরদোর গুছিয়ে ,স্নান সেরে বাজার দোকানগুলো  সেরে নিয়েছে সুমনা |
ভাইয়ার পছন্দের সাতরকম মিষ্টি কিনেছে সে |এছাড়া ভাইয়ার অতিপ্রিয় পাঁঠারমাংস ,বড়বড় গলদা চিংড়িমাছ ,দেশী হাঁসেরডিম্, কিছুই বাদ দেয়নি |ভাগ্যি রান্নার দায়িত্বটা মা নিয়েছিল |মা একবার বলেছিলো বটে ," হ্যাঁরে ,এই এতকিছু একসঙ্গে খেলে ওর শরীরখারাপ  করবেনা ?"সুমনা কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো ,"  তা বললে হয় ?ভাইফোঁটা বলে কথা |আজ তো ওর দিন |যা পারবে যতটা পারবে ততটাই খাক |তারপর নাহয় হজমের ওষুধ খেয়ে নেবে |"মা আর কথা বাড়ায়নি |
মাকে নাহয় বোঝানো গেলো | কিন্তু যিনি খাবেন তিনিতো ঘুম থেকেই  উঠছেন না |গায়ে জল ছিটিয়ে একপ্রকার জোর করেই সৌম্যকে ,মানে তার আদরের ভাইয়াকে, ঘুম থেকে তুলে দেয় সুমনা |সৌম্য আধোআধো স্বরে আদুরে গলায় বলে  ওঠে ," আর একটু শুতে দে না দিদিয়া ,প্লিজ |"
" নাহ ,আর নয় ,আর একটুও নয় | তুই এক্ষুনি ওঠ |তুই কি রে ?মা একা হাতে সব করছে |একটু সাহায্য না করলে চলে বল ?তুই তো আমার সোনা ভাইয়া ,আমার সব কথা শুনিস |উঠে পর প্লিজ | আচ্ছা বেশ ,ফোঁটাটা নিয়ে নাহয় আবার শুয়ে পড়িস |লক্ষী  সোনা আমার উঠে পড় |"সুমনা আদর করে বোঝাতে থাকে |
অগত্যা এক প্রকার চোখ না খুলেই একরাশ বিরক্তি মুখে মাখিয়ে টলতে টলতে বাথরুমের দিকে রওনা হলো সৌম্য ," ধুত্তারিকে ,একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেয়না |"
মুচকি হেসে সুমনা ঠাকুরঘরে চলে যায় |মেঝেতে আসন পেতে ,ধুপগুলো আর প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিলো সে |প্লেটের ওপর সুন্দর করে মিষ্টিগুলো সাজালো |একটা সুন্দর গ্লাসে জল দিলো |তারপর ধান আর চুয়া-চন্দন নামাতে  গিয়ে সুমনার মাথায় হাত |হে ভগবান ,দুব্বোটাইতো আনা হয়নি |কি হবে এখন ?সহজ সমাধানের খোঁজে সে রান্নাঘরের দিকে  তাকিয়ে চিৎকার করে ," মা দুব্বো আনতে ভুলে গেছি ,কি হবে এখন ?"
সৌম্য ততক্ষনে রেডি হয়ে চলে এসেছে ,বললে ,"ঘাবড়াস না আমি এক দৌড়ে গিয়ে সামনের চিল্ড্রেনপার্ক থেকে খানিকটা দুব্বো ছিড়ে নিয়ে চলে আসছি |"
"তুই যাবি ?"সুমনা অবাক |
"হ্যাঁ ,দৌড়ে যাবো আর ছুট্টে আসবো |তুই খাবারটা গুছিয়ে ফেল |আমার খুব খিদে পেয়েছে |" অনুমতির অপেক্ষা না করে সৌম্য সত্যিসত্যি এক দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো |
গোছানো তো মোটামুটি হয়েই গেছে |সুমনা উঠে পড়লো | সৌম্যর অগোছালো বাসি বিছানাটা ততক্ষনে ঠিক করে নেবার কথা মনে হলো তার | সৌম্যর ঘর থেকে বেড়িয়ে সে খানিক্ষন রান্নাঘরে গেলো ,মায়ের গাঘেঁষে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইল |আবারো  শোয়ার ঘরে চলে এলো | আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখলো ,চুলটা একটু আঁচড়ালো |অহেতুকভাবেই গোছানো জিনিসগুলো আরও  একবার  ঠিকঠাক করে রাখলো সে | সময় আর কাটছে না |সুমনা চিৎকার করে ," দেখেছো মা ভাইয়ার কান্ড ,গেছে তো গেছেই | এখনো ফিরলো না |যেখানে যাবে বাঘের মাসি "
" দ্যাখ , রাস্তায় হয়তো কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে ,আড্ডায় জমে গেছে |" মা তার ছেলের অভ্যাস জানেন |
"বাঁদর একটা ,কতক্ষনে ফিরবে তাও তো বুঝতে  পারছি না |আজ তো তাকে বকার ও  উপায় নেই | খাবারগুলো বরঞ্চ ঢেকে রাখি |" সুমনা রাগে গজগজ করতে করতে ঠাকুরঘরের দিকে রওনা হয় |
ঠিক সেইসময় ,সৌম্য দরজা ঠেলে ঢুকল | হাতে একমুঠো দুব্বো |"সরি দিদিয়া ,একটু দেরি হয়ে গেলো |"তারপর সুমনার চোখের দিকে তাকিয়ে ফের বলে ওঠে ,"দোহাই তোর্ ,আজ আর আমার ওপর রাগ করিসনা | তাড়াতাড়ি ফোঁটাটা দে |আমায় আবার এক্ষুনি বেড়িয়ে যেতে হবে |তাছাড়া খুব খিদেও পেয়েছে |"
সুমনা ঝাঁঝিয়ে ওঠে ,"খিদের কি দোষ?এক্ষুনি আসছি বলে সেই যে গেলি তো গেলি |সময়ের কোনো জ্ঞান নেই সব সময়ে ব্যস্ত | সারাদিন ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াচ্ছিস |'
সৌম্য এবার হাত জোড় করে ," বললাম তো সরি ,অন্যায় হয়ে গেছে | শেষবারের মতো মাফ করে দে,  প্লিজ | আচ্ছা, কথায়কথায় এতো রাগ করিস কেন বলতো ?"বলতে বলতেই লক্ষী ছেলের মতো আসনে  বাবু হয়ে বসে পড়ে সৌম্য ," লক্ষী দিদিয়া আমার |নে আমি রেডি |"
ওর ভাবসাব দেখে হাসি পায় সুমনার | তার সব রাগ গলে জল হয়ে যায় |সে চন্দনের বাটিতে হাত ডোবায় |
রান্নাঘর থেকে মায়ের আওয়াজ পায় ,"ছড়াটা বলিস কিন্তু ,মনে আছেতো ?"
"হ্যাঁ মা  ,মনে আছে |তুমি একটু শাঁখটা বাজিয়ে দেবে মা ?আমি একা হাতে পারবো না |' সুমনার গলায় অনুরোধের সুর |
" শাঁখটা তাহলে এখানে দিয়ে যা | আমি যেতে পারবোনা |গ্যাসে পায়েস বসিয়েছি |" সত্যিতো মায়ের যা অবস্থা |সুমনা উঠে ঠাকুরের তাক  থেকে শাঁখটা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে যায় |
কলিং বেলটা বেজে ওঠে |ওঃ এই সময়ে  আবার কে আসে | শাঁখটা  মায়ের হাতে দিয়ে সুমনা বিরক্ত গলায় সাড়া দেয় ," কে ? দাঁড়াও , যাচ্ছি |"বাইরের লোকটা বোধয় শুনতে  পায়না | ঐটুকু সময়ের মধ্যে সে আরও দুবার বেলটা টিপলো |ভারী অদ্ভুততো লোকটা | কানে কালা নাকি ? বিরক্ত সুমনা দরজা খুলে দাঁড়ায় | বাইরে দুজন পুলিশ |"এটা কি সৌম্য সরকারের বাড়ি ?"
""হ্যাঁ কেন বলুন তো " সুমনা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় |
দেখুনতো এটা কি সৌম্যর মানিব্যাগ ?"একজন পুলিশ একটা মানিব্যাগ এগিয়ে দেয় সুমনার দিকে |সুমনা ব্যাগটা হাতে নেয় |হ্যাঁ এটা তো ভাইয়ারই মানিব্যাগ |বড়মামা দিয়েছিলো ওকে |ভিতরের খাপে ভাইয়ার একটা ছবিও লাগানো আছে |সুমনা বলে ," হ্যাঁ ,এটা আমার ছোট ভাইয়ের ব্যাগ | কিন্তু এটা আপনারা পেলেন  কোথায়  ?"
পুলিশদুটো এবার একে অন্যের দিকে একমুহূর্ত তাকালো ,তারপর খানিকটা ইতস্তত করে বললো ," দেখুন একটু আগে  সামনের লেভেলক্রসিংয়ে একটা বাস ওভারটেক করতে গিয়ে আপনার ভাইকে চাপা দিয়ে চলে গেছে |স্পট ডেড |ব্যাগটা ওর পকেটেই ছিল | আপনাদের একটু আসতে হবে  |"
সুমনা হেসে ফেলে,"কি যে বলেন, আমার ভাইতো ঘরে |ভাইয়া এই ভাইয়া |" দরজায় পুলিশগুলোকে দাঁড় করিয়ে রেখেই সুমনা ঘরে ঢোকে |
কোথায় ভাইয়া ? আসনটা খালি |ঘরে কেউ কোথাও নেই |মিষ্টিগুলো একইরকম সুন্দরভাবে সাজানো | কেউ হাতও দেয়নি | সব কিছু পরিপাটি | ঠিক ভাইয়া আসার আগের মতোই | শুধু প্রদীপটা যেন কেউ এইমাত্র এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়েছে |একটা সরু ধোঁয়ার রেখা এঁকেবেঁকে  ,অনিচ্ছাস্বত্বেও ,শ্লথগতিতে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে ||

1 comment: