দুই মলাটে রহস্য –
মগজাস্ত্র
রজনী সেন রোড—রাস্তাটার নাম বললে চিনতে পারবে না, এমন কিশোর থেকে শুরু করে প্রবীণ এ বঙ্গে খুঁজে পাওয়া মুশকিল ! তবুও যাঁরা বিশ্বায়ন ও ইংরেজি বিনা জীবন বৃথা তত্ত্বের মোহে শার্লক হোমস ছাড়া বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা কাহিনী পড়োনি, তাদের সুবিধার্থে বলে রাখি এ হল সত্যজিত রায়ের অমোঘ সৃষ্টি ফেলুদা ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের বাড়ির রাস্তা ৷
ফেলুদা—এই লোকটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় আমাদের গ্রামের লাইব্রেরিতে ৷ গ্রামের বাড়িতে বসেই সেবার চলে গেছিলাম রাজস্থানে, সোনার কেল্লার সন্ধানে ৷ দেখেছিলাম ড. হাজরার শয়তানি, মুকুলের পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ আর অবশ্যই জটায়ুকে ৷ গল্প যে এত ঝরঝরে হতে পারে তার প্রথম আস্বাদ পেয়েছিলাম তখনই ৷ আর তখন থেকেই বঙ্গসাহিত্যের হাজারো মণিমুক্তোর ভিড়েও আমার প্রিয় গল্পকার হয়ে উঠলেন সত্যজিত রায় ৷
তারপর একে একে বাদশাহী আংটি, জয় বাবা ফেলুনাথ, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি, গ্যাংটকে গন্ডগোল, যত কান্ড কাঠমান্ডুতে, রয়েল বেঙ্গল রহস্য, ডবল ফেলুদা, হত্যাপুরী, নয়ন রহস্য, লন্ডনে ফেলুদা, বোম্বাইয়ের বোম্বেটে, টিনটোরেটোর যীশু, গোলাপী মুক্তো রহস্য, অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য, গোরস্থানে সাবধান—এখনকার ভাষায় যাকে বলে সিরিজটাকে সাবস্ক্রাইব করে ফেলেছিলাম রীতিমতো ৷
ছ' ফুটের ওপর লম্বা, পেটানো চেহারা, রোজ সকালে যোগাসন করা প্রখর বুদ্ধির অধিকারী ফেলুদা কখন যে আমার প্রিয় চরিত্র হয়ে উঠেছে বুঝতেও পারিনি ৷ ফেলুদার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সংস্কৃত ও অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন—এই তথ্যটা হয়তো অনেকেই জানেন না ৷ তবে এটা অনেকেই জানেন যে, লেখক সত্যজিতের অল্টার ইগো ছিলেন ফেলুদা ৷ ওঁর অনেক গুণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফেলুদার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় ৷ আবার ফেলুদাকে নিয়ে ১৯৭৪-এ যখন উনি প্রথম সিনেমা করছেন (সোনার কেল্লা), তখন সেই চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া কাউকে ভাবতে পারেননি ৷ আমার মনে আছে, সোনার কেল্লা বইটা যখন পড়েছিলাম, তখন তার কভারপেজে ছিল সৌমিত্রবাবুর ছবি !
ফেলুদার প্রথম প্রকাশিত গল্প ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি,যা দার্জিলিংয়ের প্রেক্ষাপটে লেখা, প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায় ৷ যদিও পরবর্তীতে বেশিরভাগ ফেলুদা আনন্দমেলা পত্রিকায় ও বই আকারে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৷ পরে ফেলুদার কিছু গল্পকে সংকলন করে "পাহাড়ে ফেলুদা", "ফেলুদা পাঞ্চ",
"কলকাতায় ফেলুদা'' ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে ৷
ফেলুদার অনুসন্ধিৎসু মন ওকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছিল ৷ ও যেখানে যায়, তার সম্পর্কে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে যায় ৷ আর তোপসেকে তা বলেও যাত্রার সময় ৷ এগুলো পাঠক হিসেবে আমাদের মনেও সংশ্লিষ্ট স্থান সম্পর্কে বা সংশ্লিষ্ট শব্দটি সম্পর্কে ধারণা গড়ে দেয় ৷ যেমন বাদশাহী আংটি গল্পে ফেলুদা তোপসেকে বলেছে— "অস্টিও মানে জানিস তো ?" তারপর নিজেই অস্থি থেকেই যে অস্টিও শব্দটি এসছে ও এর মানে যে হাড়সংক্রান্ত তা জানিয়েছে ৷ কৈলাসে কেলেঙ্কারি-তেও কৈলাস মন্দির, অজন্তা, ইলোরা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে ৷
ফেলুদার সহকারী ওর খুড়তুতো ভাই তোপসে, অর্থাৎ তপেস রঞ্জন মিত্র ৷ লেখক তোপসের জবানিতেই গল্পগুলো বলিয়েছেন ৷ আমরা যেন নিজেকে ঐ আসনে অজান্তেই বসিয়ে নিয়েছি ৷ একমাত্র "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি"
গল্পতেই তোপসে-কে ফেলুদা মাসতুতো ভাই বলেছিল, কিন্তু তারপর থেকে খুড়তুতো ভাই সম্পর্কটাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ৷
ফেলুদার অপর এক অপরিহার্য অঙ্গ লালমোহন গাঙ্গুলী, ওরফে জটায়ু ৷ ওঁর সাথে প্রথম আলাপ "সোনার কেল্লা" গল্পে রাজস্থানগামী ট্রেনে ৷ "প্রখ্যাত্ রহস্য রোমাঞ্চ্ ঔপন্যাসিক্" বলে নিজের পরিচয় শুরু করেছেন উনি ৷ তারপর ফেলুদার প্রখর পর্যবেক্ষণশক্তির নমুনা পেয়ে ওদের সঙ্গে 'ঝুলে পড়েছেন' ৷ ফেলুদার রহস্যোদ্ধারের মাঝে খানিকটা মজার টাটকা বাতাস এনে দিয়েছেন উনি ৷ ওঁর সংগ্রহের এক-একটি অস্ত্র মাঝে মাঝেই কাহিনীর ক্লাইম্যাক্সের গতিসঞ্চারক হয়েছে ৷ যেমন- যত কান্ড কাঠমান্ডুতে গল্পে বৌদ্ধ জপযন্ত্র ৷ ওঁর হিরো প্রখর রুদ্র, ওঁর উপন্যাসের অনুপ্রাশীয় নাম (যেমন-সাহারায় শিহরণ, হংকংয়ে হিমশিম) আর ওঁর ইংরেজির ভুল উচ্চারণ আমাদের হাসিয়েছে ৷
ফেলুদার সবচেয়ে বড় শত্রু অবশ্যই মগনলাল মেঘরাজ ৷ জয় বাবা ফেলুনাথ আর যত কান্ড কাঠমান্ডুতে এই দুটো গল্পে উনি ভিলেন ৷ কিন্তু তাতেই ফেলুদাকে বেগ দিয়েছেন ৷ জটায়ুর প্রতি ওর বিশেষ 'অনুরাগ', তাই 'আঙ্কল'-কে উনি নানাভাবে হেনস্থা করেন ৷
ফেলুদা যখন আমি পর্দায় প্রথম দেখি, তখন তা টিভিতে "ফেলুদা ৩০" নামে সম্প্রচারিত হচ্ছে ৷ সব্যসাচী চক্রবর্তী ফেলুদা, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় তোপসে, রবি ঘোষ জটায়ু (রবিবাবু মারা যাওয়ার পর অনুপ কুমার ) ৷ পরে সৌমিত্রবাবু-সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়-সন্তোষ দত্তদের দেখি ৷ তাই আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সব্যসাচী চক্রবর্তীই সেরা ব্যোমকেশ ৷ পরবর্তীতে আবীর চট্টোপাধ্যায়কে ফেলুদা হিসেবে, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য, সৌরভকে তোপসে হিসেবে আর বিভু বন্দ্যোপাধ্যায়কে জটায়ু হিসেবে আমরা পেয়েছি ৷ এখনও পর্যন্ত সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, বাদশাহী আংটি, বোম্বাইয়ের বোম্বেটে, গোরস্থানে সাবধান, রয়েল বেঙ্গল রহস্য, টিনটোরেটোর যীশু ইত্যাদি গল্পগুলি সিনেমার পর্দায় এসছে ৷ মগনলাল মেঘরাজ হিসেবে উৎপল দত্তের অভিনয় সকলের মন কেড়েছে ৷ এছাড়া লালমোহনবাবুর বন্ধু পুলক ঘোষালের চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় সকলের তারিফ কুড়িয়েছে ৷ এমনকি হিন্দিতেও শশী কাপুরকে ফেলুদা করে জাতীয় স্তরে কাজ হয়েছে ৷ আগামী প্রজেক্ট সম্ভবত "যত কান্ড কাঠমান্ডুতে"—খোঁজ চলছে উপযুক্ত ফেলুদা (বয়সজনিত কারণে সব্যসাচী সরে এসছেন), জটায়ু (বিভুবাবুর প্রয়াণ ঘটেছে) ও অবশ্যই মগনলাল মেঘরাজের ৷
বাংলা সাহিত্যের এত গোয়েন্দা চরিত্রের ভিড়ে ফেলুদার এই সব গুণাবলীই ওকে আলাদা করেছে ৷ আগামী প্রজন্মও হয়তো ফেলু মিত্তিরকে ততটাই ভালোবাসবে, যতটা ভালোবাসি আমরা ৷
অন্যতম সেরা লাগলো
ReplyDelete