অণুগল্প-
মণিহার
দত্তবাড়ির পৈতৃক মণিহারটা গত দশদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে
না। শুধু বাড়িতেই নয় সারা
গ্রামেই ব্যাপারটা
নিয়ে একটা হূলস্থূল পড়ে গেছে,
আর হবে নাই’বা কেন__প্রায় তিনশ বছর ধরে ওই মণিহারটা দত্তবাড়িতে আছে; এমনকি হার’টার অলৌকিক
মাহাত্যের গুজবও নেহাত কম নয়।
ঘরে পড়ার টেবিলে মুখ
গুঁজে বসে ছিল মনু।বাড়ির
আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত।হারের খোওয়া যাওয়াটা একদিকে যেমন বয়জ্যেষ্ঠদের কাছে সম্মানহানী ও অমঙ্গলের
পূর্বাভাস সেখানেই বাবা-কাকাদের
কাছে সেটা একটা
প্রাইসলেস প্রপারটি লোপাট হওয়ায় মস্ত আর্থিক ক্ষতি।তাই সব মিলিয়ে সবার কপালেই গাঢ় ভাজ।
“বাগানের বকুলগাছটা ক’দিন হল কেমন যেন
শুকিয়ে যাচ্ছে না’রে?” কথাটায় চমকে উঠে মনু তাকিয়ে দেখল জানালা দিয়ে পিছনের বাগানটার দিকে তাকিয়ে
আছে রিমলি।কখন চুপিসাড়ে সে ঘরে
এসে ঢুকেছে মনু সেটা
টের পায়নি।মনু আর রিমলি সমবয়সি তুতো ভাই-বোন।এমনিতে মনুর স্নায়ু খুবই সজাগ কিন্তু কদিন ধরেই
বাড়িতে যা সব ঘটছে তাতে ওর
মেজাজটাও গুলিয়ে
গেছে।সে উঠে গিয়ে জানালায় রিমলির পাশে দাঁড়ালো,
বলল- “হ্যাঁ রে আমিও লক্ষ্য করেছি। হারটা চুরি
যাওয়ার দুদিন পর থেকেই দেখছি
ব্যাপারটা।বড়
ঠাম্মিকে বলতে গেলাম; তিনি তো কপালে চোখ
তুলে হাউ-হাউ করে
উঠলেন—এসব নাকি হার চুরির প্রকোপ।আর এসবে
পোয়াবারো হচ্ছে আমাদের শ্রীমান
গুরুদেব বাবাজির।দোষ
কাটাতে উপছে পড়ছে তাঁর নৈবেদ্যর ঝাঁপি।কার সর্বনাশ আর কার পৌষমাস!”
“আমার কিন্তু কেমন খটকা লাগছে!” বিছানার উপর একতাড়া ম্যাগাজিনে
অন্যমনস্কভাবে হাত বোলাতে বোলাতে রিমলি বলল,
“তবে কি__”
ওদের চোখ চকচক করে
উঠল।বেশ ভালোই বোঝা যায় দুজনের সন্দেহের তীরটা একই নিশানায় গিয়ে লেগেছে। তবে তো একবার
ব্যাপারটা ঘেঁটে দেখতে হচ্ছে তাও
পাখি ওড়ার আগেই।
দুজনে চাপা আওয়াজে অনেক্ষন ধরে কী’সব পরামর্শ করল, প্ল্যান কষল তারপর রিমলি ফিরে গেল নিজের ঘরে।
আরও পাঁচদিন কেটে গেছে।ধড়পাকড় তল্লাশি জেরা সবকিছু
করেও হারচুরির কোনও সুরাহা পুলিশ
করতে পারল না।রিমলি
মনুও একেবারে চুপচাপ।সমস্যা সমাধানের উপলক্ষে বাড়িতে এক মস্ত যজ্ঞের আয়োজন করিয়েছেন
গুরুদেব।তিনি ভরসা দিয়েছেন যজ্ঞ সুসম্পন্ন
হলেই তিনি তাঁর
যোগবলে জানতে পারবেন এই অপকর্ম কে করেছে এমনকি হৃত সম্পদ পুনরূদ্ধার করতে পারবেন বলেও তাঁর দৃঢ়
বিশ্বাস।
আজ সন্ধ্যাতেই যজ্ঞের শুভলগ্ন।বাড়ির
পূর্বদিকের নিরিবিলি নাটমন্দিরে সাজানো
হয়েছে যজ্ঞের
বেদী।গুরুদেবের পাশেই তাঁর দু’জন শিষ্য।আর অপর
পাশে পুরো দত্ত পরিবার।গুরুদেব
আপন যোগবলে তাদের মণিহার উদ্ধার করবেন__সেই অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে মুখিয়ে আছে
সকলেই।কয়েকখানা অবোধ্য মন্ত্রোচ্চারের পর
গুরুদেব একমুঠো
বিভূতি তুলে আগুনে আহুতি দিতে যাবেন ঠিক তখনই একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এল, “কী গুরুদেব শিষ্যকে ছাড়াই যজ্ঞে বসে গেছেন”।
রিমলি আর মনুর সাথে থানার বড়বাবু এসে হাজির
হয়েছেন, আর তার পাশেই হাতকড়া
পরানো একটা লোক।তাকে দেখেই
ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন গুরুদেব।
বাড়ির বড়কর্তা
ব্যস্তভাবে এগিয়ে এসে বললেন,
“এসব কী হচ্ছে অফিসার? আপনারা এমন সময়__”
আমরা ঠিক সময় এসে পড়েছি বলেই সকলের পৈতৃক
প্রাণটা এযাত্রায় বেঁচে গেল। আপনারা
বোধহয় এই গুরুদেব
মহোদয়কে ঠিকমতো চিনতে পারেননি,
দাঁড়ান__” বলেই এক হ্যাঁচকায় গুরুর মুখের দাড়িটা খুলে ফেললেন
বড়বাবু।
গুরুর চেহারা দেখে
আঁতকে উঠল সব্বাই।এ যে জেল ফেরার দাগী খুনী।টিভিতে এর খবর দেখানো হয়েছিল।এর
খপ্পরেই পড়েছিল দত্তপরিবার!
ছোটোকর্তা বড়কর্তা দুজনেই বিনম্রভাবে ধন্যবাদ
জানালেন।একগাল হেসে বড়বাবু বললেন আমাকে
নয় ধন্যবাদ জানান
আপনাদের বাড়ির এই দুই খুঁদে গোয়েন্দাকে। যা করার এরাই করেছে।”
এবার রিমলি বলতে
শুরু করল, “ও ব্যাটাকে আমাদের প্রথম থেকেই ডাউট
লেগেছিল।যেদিন হারটা চুরি গেল সেদিন ভোররাতে ওকে বাগানে যেতে দেখেছিলাম। তারপর বকুল গাছটা
শুকিয়ে যাওয়াতে সন্দেহটা গাঢ়
হল।কিন্তু প্রমান
ছাড়া বাড়িতে কিছুই বলা যাবে না তাই ভিতরে ভিতরে খোঁজ নিতে লাগলাম।থানার সাথেও যোগাযোগ
রেখেছিলাম।কিন্তু বাবাজির প্ল্যান ছিল
নিখুঁত__নো ফাঁক।তারপর হটাৎই সেদিন গল্পের মোড়
ঘুরে গেল।বাবাজি চুপিসাড়ে
দেখা করতে গেছিলেন
এই চেলাটির সাথে।তখন বাবাজির আসল চেহারা দেখেই সবটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল।আর যাবে কোথায়__ঘুঘু পড়ল ফাঁদে।”
গল্প শেষ হলে ঠাম্মি
জিজ্ঞেস করলেন, “তবে আমাদের মণিহার__”
মুচকি হেসে মনু সবাইকে নিয়ে গেল বাগানের বকুলতলায়।গাছের
গোড়া খুঁড়ে বের করে আনল
একটা বাক্স।সেটা
খুলতেই টর্চের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল দত্তবাড়ির মণিহার।
ছোটরা ভীষণ আনন্দ পাবে
ReplyDelete