বড়গল্প -
ধূপছায়া
কুল খাবে, কাঁচা
কুল সঙ্গে নুন আর শুকনো লঙ্কা গুড়ো,
আহা! এ স্বাদ অমৃত সমান । ছাদে বই নিয়ে পড়তে বসেছিলাম একমনে, মিঠির
ডাকে একটা শিহরণ বয়ে গেল পুরো
শরীর বেয়ে । দুপুরের এই
সময়টা খাওয়া দাওয়ার পর আমি প্রতিদিন ছাদের একটা নির্দিষ্ট
কোনে থাকি, আচমকা কেউ খুঁজে না পেলেও মিঠি জানে আমি কোথায় আছি । কারন পড়ার থেকেও অপেক্ষাটা বেশি থাকে মিঠির
জন্য, বিশেষত কলেজের ছুটির
দিনগুলো শুধু এই দুপুরটারই
অপেক্ষা করে বেশি । কোনদিন কুল, কোনদিন আমড়া,
কাঁচা পেয়ারা থেতো করে, সরষের
তেল দিয়ে মাখো মাখো করে বাতাপি লেবু সবকিছুই খাওয়া
শিখেছিলাম মিঠির কাছে ।
মিঠি
আমার সেই কবেকার বন্ধু, আমাদের
বাড়ি আর ওদের বাড়ি গায়ে লাগিয়ে । দুটো
ছাদের মধ্যেখানে শুধু আড়াই
ফুটের একটা পাঁচিল, আর ব্যবধান বলতে দু বাড়ির জাত আর
দুজনের বয়স । নাহ! তাই বলে আমাকে আর মিঠিকে
এসবের কেউ কখনও ছুঁতে পারেনি, বরং
মিঠি আর আমার শরীর বেশ কয়েকবার ছুঁয়েছে । কই বুঝিনি তো মিঠির জাত কি?না সত্যি বলছি প্রতিবার মনে হয়েছে মিঠি আমার থেকে অনেক উঁচু, আর সবার থেকেও অনেক অনেক উঁচু । মিঠি আমাকে বিশ্বাস করে, মিঠি
আমাকে ভালোবাসে, আমি মিঠির ভরসা ।
আজ
অনেক কুল নিয়ে এসেছে মিঠি, ছাদের
এই কোনের দিকটা দুপুরের এই সময়টা বেশ
ধূপছায়া থাকে ।
এ্যকাউন্টেসির বই আর খাতাটা সামনে,
অথচ মিঠিকে দেখে সব জাবদা গুলো ভুল হয়ে যাচ্ছে । দুদিন আগে মিঠির সাথে খুব ঝগড়া
হয়েছিলো, আগেরদিন কথা দিয়েও সে আসেনি,
কারনও
জানায়নি
। আজ না বলেই এসেছে,
হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ
পড়ে, মাথায় লাল রঙের একটা
ছোট্ট টিপ । ঠিক যেমন আমি
পছন্দ করি, মিঠি জানে আমার রাগ ভাঙানোর মাসুল কি । তবে মিঠি আজ এই সাজের সাথে চুল বেঁধে রেখেছে কেন? কেন চুল
খোলা রাখেনি? তাহলে কি.... ,
দেখো
আমি কিন্ত অনেক লুকিয়ে
তোমার জন্য কুলগুলো এনেছি, আজ যদি না খাও তবে
কিন্তু আর পাবেনা । আর
পাওয়া যাবে না মানে? এখন তো কুলেরই সময়,
তবে কি মিঠি আর আসবেনা আমার কাছে?
রাগ অভিমান ভুলে জাপ্টে
ধরলাম মিঠিকে, এর আগেও কতবার
মিঠিকে এভাবে আমি ধরেছি ।
ঝগড়া হওয়ার দিন দুই আগেও থেঁতো পেয়ারা খেতে খেতে মিঠির
ঝাল লাগলে মিঠির ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁট দিয়ে মিঠির সব ঝাল আমি হরণ করেছি ।
মিঠির মিঠে কড়া প্রশ্রয়ে আমি অশান্ত হয়ে উঠেছি বারে বারে । মিঠির উপর একটা জন্মসিদ্ধ অধিকারবোধ কিভাবে যেন তৈরী হয়ে চলেছে
প্রতিনিয়ত । এ অধিকার দেখার নয়,
এ অধিকার আইনত প্রমানিতও
নয়, এঅধিকার শুধুই আমার আর মিঠির অনুভূতির
। শুধু মিঠির শরীর নয়, মিঠির মন,প্রান, মায়া সবকিছুতেই শুধু আমি আর আমি
। মিঠি জানে কি প্রচন্ড ভালোবাসি আমি তাকে,
মিঠি জানে কিভাবে তিলে তিলে আমি তাকে নিয়ে আমার স্বপ্নমহল গড়ে চলেছি প্রতিনিয়ত ।
না আজ মিঠি শুধু আমার আর আমার,
আজ রাতের শেষ প্রহর
পর্যন্ত আমি মিঠির রসে মাতাল হয়ে উঠবো ।
আমার
হাতটা মিঠির হাতে রাখতেই
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো, স্পষ্ট বুঝলাম মিঠি
এইমুহুর্তে আর কিছু চায়না
। তবে , তবে কেন সে হলুদ শাড়ি আর লাল টিপ পড়ে এসেছে ।
প্রায় জোর করেই মিঠির কোমড়ে হাত দিয়ে বুকের কাছাকাছি টেনে নিলাম তাকে, এবারেও বাধা দেবার একটা কপট চেষ্টা সে করলো । আস্তে আস্তে
বিকেল হয়ে আসছে,সূর্য্য পশ্চিমাকাশে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে । একটা লাল আভা
আমাদের ছাদটাকে গ্রাস করছে খুব সন্তর্পনে, এই
গোধূলীবেলায় মিঠির চোখদুটো কি ভীষন
মায়াবী হয়ে পড়েছে । আমি এক
ঝটকায় মিঠির গোছানো চুল খুলে দিলাম,
মিঠির ঠোঁটে আমার ঠোঁট রেখে দিলাম । তিরতির করে কাঁপছে মিঠির ঠোঁট দুটো, অদ্ভুত
শিহরণে চোখ বুজে ফেলেছে সে,
আর আমি অপলক দৃষ্টিতে পান
করতে থাকলাম মিঠির সৌন্দর্য্য
। মিঠি আলগা করে দিয়েছে তার শরীর, দুজনেই
সম্বিত হারিয়ে ফেলেছি সেইমুহুর্তে
আর ঠিক সেই সময় আচমকা আমাকে
এক ঠেলায় দূরে সরিয়ে দিলো মিঠি, আমি কেন জিজ্ঞেস করতেই ও উদ্যেত হলো চলে যাওয়ার জন্য ।
সাঁতপাঁচ না ভেবে এক ঝটকায় মিঠির ওড়না ধরে টান মারলাম, বে
আব্রু হতেই দেখলাম মিঠির মুখ লজ্জায়
লাল হয়ে গেছে । বুঝলাম
অজান্তে এই ভুলটা করা আমার উচিৎ হয়নি,
তৎক্ষনাৎ ক্ষমা চাইতেই আমি যায় বলেই পা বাড়ালো মিঠি । মিঠির চোখের
কপট অভিমান চিনতে আমার ভুল হয়নি,না আজ মিঠিকে যেতে দিলে চলবেনা । আমি যদি ভুল না হয় তাহলে নির্ঘাত ও বিশেষ কিছু বলতেই আজ এসেছিলো , আজ না
বলে চলে গেলে হয়তো আর কোনদিনই বলবেনা । বড় চাপা স্বভাবের মেয়ে, ভাঙবে
তবু চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বের হবেনা । তাই বলে মিঠি যে কাঁদেনা তেমন নয়, তবে সে
কান্না আবেগের, অভিমানের ।
মিঠি
আজ কি তুমি কিছু বলতে
এসেছিলে, আমি জানি তুমি মিথ্যে বলবেনা । না তেমন কিছু নয়, আমি আজ যায় । স্পষ্ট বুঝতে পারছি মিঠির চোখে অনেক প্রশ্ন, কোথাও যেন একটু হলেও কিন্তুর অবকাশ রয়েছে । বেশ দৃড়তার সাথেই
বললাম, আমি কিন্তু
নিশ্চিত তুমি কিছু বলতেই
এসেছো তাই বলে ফেলো । সন্ধ্যে হয়ে আসছে,
না শুনে কিন্তু আমি ছাড়বোনা । মিঠি ইতস্তত করছে দেখে আমি ওকে সহজ
করার জন্য একটু মজা করলাম, আচ্ছা মিঠি আজ এতো সেজেছ কি ব্যাপার কোন ছেলে দেখতে এসেছিলো বুঝি? না অন্য কোন বিশেষ কেউ । মিঠি তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু একটা
দারুন পাজ্ঞাবী পরবো,
তোমার যে টিয়া সবুজের
পাজ্ঞাবীটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ সেটাই
আমি পরবো । মজাটাতে দারুন
কাজ হলো, এক ঝাঁপে মিঠি আমার বুকে ,
আমাকে জাপটিয়ে ধরেছে । আমি মিঠির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, আমি
জানি ওর মাথায় আমার হাত থাকলে ওর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে, মিঠি
সবসময় বলে ও নাকি যখন কোন মানসিক অবসাদে ভোগে তখন ম্যাজিকের মত কাজ করে আমার হাত । ওর মনে হয়
যাবতীয় টেনশান সব ভোজবাজির মত উবে যায়,
মিঠি আমাকে কখনও কখনও
আদরকরে তাই জিয়নকাঠি বলে ডাকে । ও বলে ওর যদি কখনও মৃত্যুও হয়
তাহলে নাকি একমাত্র আমার স্নেহের হাতই নাকি ওকে মৃত্যুর মুখ থেকেও কেড়ে নিয়ে
আসতে পারে । পাগলী একখানা,
ও জানেনা আমি ওর জন্য
হাজার বার মরতে পারি কিন্তু মিঠি
একবারও নয় । না মিঠিদের
মরতে নেই, ওরা অমর ।
কতক্ষন
হয়েছে জানিনা, হঠাৎ
বুকের কাছটা ভিজে ভিজে লাগতেই বুঝতে পারি পাগলীটা কাঁদছে
। বুক থেকে সরিযে মিঠির চিবুকটা তুলে ধরি আমি,
দুচোখ বেয়ে জলধারা বইতে থাকে । কান্না কোনো ক্ষেত্রেই ভালো নয়, কিন্তু
মিঠির পটলচেরা চোখে এইমুহুর্তে জলটা যে অসম্ভব ভালো লাগছিলো তা বলাই বাহুল্য । গোধূলীর
শেষ লগ্নে রক্তিমআভাটা মিঠির মুখে পড়তেই কি অদ্ভুত মায়াবী মনে
হচ্ছিল ওকে । মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এই বিশেষ মুহুর্তটা আমার আর মিঠির
জন্যই তৈরী করেছে । উত্তরের দিক থেকে একটা সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে, কয়েক
ফোঁটা জল আমাদের গায়ে পড়তেই বুঝলাম এবার যেতে হবে । কিন্তু মিঠি তো বললোনা ও
কি বলতে চাই, এভাবে যে যেতেও পারবোনা । বলো মিঠি, তুমি
কিছু বলতে চাও? দেখো বৃষ্টি
পড়ছে, দয়া করে
কিছু বলো । ঠোঁট দুটো ইষৎ কাঁপছে, এই বুঝি মুখ খুলবে
........
বৃষ্টির
তীব্রতা হঠাৎই করে বেড়ে
গেলো, একদিকে আকাশে তখনও সূর্য্যস্তের শেষ রক্তিম আলো তার মধ্যে বৃষ্টি
। উফ! পুরো
মোহময় পরিবেশ, প্রেম করার জন্য একেবারে উপযুক্ত । খুব কাছাকাছি কোথাও একটা ভীষণ জোরে বাজ পড়লো , চমকে
উঠলাম দুজনেই ।এক ছুটে
পৌঁছৈ গেলাম চিলে কোঠার ঘরে , এই চিলে কোঠার ঘরেই আমার সব কিছু । এই ঘরটা
যেহুতু আমার তাই এই ঘরে খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ আসেনা,
ঘরটার আলোকসজ্জা থেকে পর্দা,
সবকিছুই আমার পছন্দের ।
তবে এই ঘরটারে আর একজনের পছন্দও স্বীকৃতি পেয়েছে সে হলো মিঠি, সে মাঝে
মাঝেই এই ঘরটা পরিস্কার করে, গুছিয়ে রাখে আমার যাবতীয় পড়ার বই, খাতা, কাগজ ।
গত বছর রঙ করার সময় মিঠি নিজের থেকে রঙ পছন্দ করেছিলো,
ও সবসময় একটু হালকা ধরনের
রঙ পছন্দ করতো ।আমার
বইয়ের টেবিলে যে ফুলদানিটা আছে সেটাও মিঠিরই দেওয়া,
এইবছর আমার জন্মদিনে আমার পাওয়া সেরা উপহার ।
চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতই আবার একটা বাজ পড়লো, ভয়ে
মিঠি আমাকে জাপটে ধরলো । এরপর মুহুর্মুহু বেশ কয়েকটা বাজ পড়লো,
মনে
হচ্ছে ছাদফুটো করে এই বুঝি
আমাদের ছুঁয়ে ফেলে । এবারে আকাশ বেশ কালো করে এসেছে, জানলাটা
বন্ধ হওয়াতে চারিদিকে অন্ধকার ঘুটঘুটে । মিঠি সেই যে আমাকে জড়িয়ে
ধরেছে তারপর আর ছাড়ার নাম নেই, সত্যি বলতে কি আমি নিজেও চাইছিলাম না মিঠি
আমাকে ছাড়ুক তাই আমিও বেশ শক্ত করেই মিঠিকে ধরে রেখেছি । বৃষ্টির ধরন দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলোনা যে ঘন্টা দুই আমাদের খোঁজে ছাদে
কেউ আসবেনা, তাই
একপ্রকার বেশ সাহসীই হয়ে
গেলাম । এইবার রাশ আলগা করলাম, মিঠির ঠোঁটে আমার
ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম । এবারে
মিঠিও সাড়া দিলো, নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পন করে দিলো
আমার কাছে। এভাবে মিঠিকে পাবো কখনও কল্পনা করিনি , এমনিতেই
মিঠির আজকের সাজ পোষাক আমাকে আকৃষ্ট করেছে তার মধ্যে আজ বারেবারে
মিঠি আমাকে ধরা দিয়েছে । এক হ্যাঁচকায় মিঠির বেঁধে রাখা চুল খুলে দিলাম, আবার
একটা বাজ পড়লো, জানলা দিয়ে যে আলো এলো তাই দিয়ে মিঠির সৌন্দর্য্য পান করলাম
অকাতরে । নাহ! আজ
সম্পূর্ণ অন্য মিঠি, আজ আর সেই লাজুক মিঠি নেই
। মিঠি এখন দামাল হয়ে গেছে, মিঠির যৌবন,
রুপ রস, গন্ধ
আমাকেও দামাল করে দিচ্ছে । আমি ধীরে
ধীরে বেশ বুঝতে পারছি মিঠি
ছাড়া আমার কোন অস্তিত্ব নেই,থাকতেই পারেনা ।
মিঠি শুধু আমার, শুধু
আমার আর আমার ।
সবাই
গোল করে বসে আছে বেঞ্চের
ঐদিকটায়, ভালো করে কান পাতলে বোঝা যাচ্ছে একটা জটলা ।
একি! আমার বাবাকে দেখছি এক
জায়গায় বসে আছে, বাবাকে ঘিরে আছে জনা কয়েক বাবার বন্ধু । কি ব্যাপার, তাহলে
কি আজ আমাদের বিচার বসেছে? হ্যাঁ
আমার আন্দাজ একদম ঠিক, মিঠি
এসে এইমাত্র খবর দিলো যে ঐ দিকের জটলায় বসা
লোকগুলো আমাকে আর মিঠিকে
নিয়ে জটলা করছে । মিঠির চোখে রাগ আর ঘৃনা দেখতে পাচ্ছি, কি
ব্যপার মিঠি কি হয়েছে ? ওরা কি আলোচনা করছে বলো?
মিঠি
ঘৃনাভরে ওদের দিক করে
একদলা থুতু ফেলে বললো ওরা তোমার আর আমার সম্পর্ক নিয়ে নোংরা
নোংরা কথা বলছে । আমি হা হা করে হেসে উঠলাম,
বললাম ওরে পাগলী কেউ নোংরা ছড়ালেই কি আর আমাদের সম্পর্ক মলিন হয়ে যাবে ।
আমাদের প্রেম অমর, অজেয় ।
আমার
বাবা যেদিকটাই বসে
সেদিকটাই আমরা দুজনেই হাত ধরাধরি করে এগোলাম । সামনে যেতেই
দেখলাম বাবা কাঁদছেন, বাবার বন্ধু বিমল কাকু,
রজ্ঞিত কাকুরা বাবকে কি যেন বোঝাচ্ছেন । আমি বাবার কাছে জানতে চাইলাম কি হয়েছে না
বাবা কিছুই জবাব দিলোনা, একে একে বিমল কাকু,
রজ্ঞিত কাকু সবাইকে
জিজ্ঞেস করলাম তবুও কেউ জবাব দিলোনা । বেশ বিরক্ত বোধ করলাম, মিঠির
দিকে চাইতেই দেখি মিটিমিটি
হাসছে । কি ব্যপার বলোতো
মিঠি, ওরা জবাব দিচ্ছনা কেন?
মিঠি আঙুল দিয়ে ইশারা করলো ওদিকটায়,
দেখলাম দুটো শবদেহ রাখা
আছে । হঠাৎ এক চিলতে ঝড়ো হাওয়ায়
চাদর দুটো উঠতেই ঝলসানো
মুখ দুটোতে আমাকে আর মিঠিকে চিনতে আমার একটুও অসুবিধা
হলোনা ।
No comments:
Post a Comment