বড়গল্প –
'ইতি'-কথা
ভাটপাড়ার যোগেন্দ্রনাথ চাটুজ্জের বাড়ি থেকে ডাক এলো। সময়টা
আষাঢ় মাস। আমাদের নলহাটা গ্রাম
যেন নতুন করে সবুজের চাদর কে বিয়ে করেছে।যে দিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। যোগেন্দ্র নাথ হলো ভাটপাড়ার এক মস্ত বড়
জমিদার। আর আমি এক সামান্য শিক্ষক।তবে
এ বিষয়ে আমার একটু নাম ডাক ছিল বৈকি। লেঠেল এসে অতি সুবিনোয়ে বলে যায় পরশু বিকেলে জমিদার যোগেন্দ্র নাথ দেখা করতে
চায়।কি দরকার তা অবশ্য বলেনি।আমিও
জিজ্ঞেস করিনি।এই লেঠেলদের আমি একটু এড়িয়ে চলতাম। যাকে তাকে মাথায় বারি মারা এদের একটা বিশেষ চারিত্রিক লক্ষণ
ছিল। যাইহোক,আমিও
সেই মতো তৈরি
হলাম - দিনটা ছিল ১৬ই আষাঢ়,১৯১২।
কাদা জল পেরোতে হয়নি।যথা সময় যোগেন্দ্র নাথ একটা পালকি
পাঠায়।তাতে চড়েই আমার যাত্রা
শুরু।মাঝে মাঝে পালকির ভিতর থেকে উঁকি মেরে নিজেকে বাইরে দেখানো।নিজেকে মুহূর্তের বোকামিতে এক জমিদার ভাবা-
এসব নিয়েই চলছি হঠাৎ কখন পৌঁছে
গেলাম ভাটপাড়া জমিদার বাড়ি। কিছুটা বিষণ্ন মনেই পালকি থেকে নামলাম।স্বপ্নের যাত্রা আর একটু চললে বেশ হত!!
যোগেন্দ্র নাথ এক প্রবাদ প্রতিম মানুষ ছিলেন।তার ভয়ে বাঘে
গরুতে এক ঘাটে জল খেতো।এসব আমার
জানাই ছিলেন।তা যাই হোক,তার
সেই বিশাল অট্টালিকায় পৌঁছনোর পরই এলো আমার
পরম প্রিয় লুচি আর হালুয়া।সাথে দু টো মিষ্টি।এক ভৃত্য এসব দিয়ে বলে যায়, জমিদার
বাবু এখন মুন্সী বাবুর সাথে আছেন তাই আসতে সময় লাগবে।আমি প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও চারপাশ দেখে ধীরে ধীরে খেতে
শুরু করলাম।ভাবলাম,এ অভাগার ভাগ্যে যদি রোজ রোজ এমন জুটত তাহলে হয়তো জীবন
অনেক সুন্দর তা আমিও বুঝতে
পারতাম।ছোট বেলায় বাবা মা গত হন।মামার কাছে মানুষ।পরে এক প্রাথমিক বিদ্যালয় এ কাজ পেয়ে এই নলহাটী তে আসা।আর কোনো বিশেষ
লক্ষণ নেই বলে সাত পাকের
দুরন্ত ঘূর্ণিতে এখনো ছোটা হয়নি।যা অতীব সৌভাগ্যের পরিচয় বলেই আমার বিশ্বাস।
এতো গেলো আমার পরিচয় এবার গল্পে ফেরা যাক।খাওয়া দাওয়া
শেষ হতেই ডাক আসলো ভিতরে যাওয়ার।আমি
যে ঘরে ছিলাম সে এক বিশাল দালান ঘর,চারিদিকে
হরিণ আর অন্য পশুর কঙ্কাল
পালিশ করে দেওয়ালে ঝোলানো।আর আতরের গন্ধ।খুব মিষ্টি একটা গন্ধ।যাইহোক,এখন
যে ঘরে গেলাম সেটা অপেক্ষাকৃত ছোট।নিচে গদি বিছানো - ধপধপে সাদা।আমার পা আবার একটু ময়লায় ছিল।ঘরে ঢুকেই থমকে
গেলাম।হঠাৎ এক গুরু গম্ভীর
কন্ঠস্বর -
- অতো ইতস্তত হওয়ার কিছু নেই মাস্টার মশাই।চলে আসুন।
নরম গদিতে হেলান দিয়ে একটা বালিশ পায়ের তলায় রেখে বসে
আছে যোগেন্দ্র নাথ। চুপিসারে
ঢুকলাম।যেন হরিণ নিজের ইচ্ছাতেই শিকারির কাছে যাচ্ছে - তারই ডাকে।
যোগেন্দ্র নাথের চার মেয়ে।ছোট মেয়েকে বাংলা পড়ানোর জন্যই আমায়
ডেকে আনা।এতে অবাক হওয়ার
কিছুই নেই।যেটা অবাক হওয়ার বিষয় সেটা হলো তার ছোটো মেয়ের নাম - 'ইতি'।আসলে তিন মেয়ের পর আর কন্যা সন্তান চাইনি যোগেন্দ্র নাথ।তাই
এই নামকরণ।তবে
ইতির পর তার আর কোনো সন্তানই জন্মায়নি।কারণ তার স্ত্রী মারা যায়।
এক সঠিক দিন দেখে পড়ানো শুরু করতে বলা হলো।আর এটাও বলা
হলো যে আমার যাওয়া আসার
জন্য একটা পালকি আসবে।মোটা মাইনের কথা শুনেও অত খুশি হয়নি যতটা এই কথা শুনে হয়েছিলাম।
ইতি কে আমি প্রথম দেখলাম এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পর যখন
পড়াতে এলাম আমি প্রথমবার।বয়সে
আমার থেকে অনেক ছোট।কিন্তু একেবারেই বাচ্ছা না।সে তখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী।সব সময় একটা তাঁতের শাড়ি পরে আসতো।আর
যত বার আসতো সাথে নিয়ে আসতো
সেই মিষ্টি আতরের গন্ধ।যত দিন গেল জানতে পারলাম জমিদার বাড়ির অনেক গল্প।অনেক অল্প সময়ে আমরা অনেক ভালো বন্ধু হয়ে
উঠলাম।আর হবেই না কেন আমি যে তখন
সবে আঠাশ এ পা দিয়েছি।তাই পড়ানো চলতো আর সাথে চলতো গল্প।আমরা বসতাম ছাদের ঘরে।খুব নিরিবিলি জায়গায়।ইতি শোনায় ,তার তিন দিদির বিয়ে হয়ে গেছে অনেক কম বয়স এ।এই আতর তারই পছন্দ তাই গোসাই সাহেব কে
বলে কলকাতার বড়বাজার থেকে
নিয়ে আসা হয়।তার মা তাকে জন্ম দেওয়ার এক বছরের মাথায় মারা যায়-কালা জ্বর এ।সেই থেকে ওই গোসাই সাহেব তাকে মানুষ
করে।গোসাই সাহেব হলেন তার বাবার ছোট
বেলার বন্ধু।খুব গরিব তাই এই বাড়িতেই মানুষ ছোট থেকে।এই বাড়ির পিছনে নাকি অনেক স্বদেশী একবার কোন ইংরেজ কে মেরে এসে
লুকিয়ে ছিল।তিন দিন পর তারা পালায়
এখান থেকে। - এরকমই অনেক রকম গল্প হতো।একদিন হঠাৎ আমায় এক নতুন পাঞ্জাবি দাওয়া হলো।পরে জানলাম যে সেটা ইতির আবদার
ছিল তার বাবার কাছে।জেনে ভালোলাগলো।তবে
সত্যি বলতে ইতি কে নিয়ে আমার মনে কোনো বিশেষ জায়গা তৈরি হয়নি।একটি খুব সুন্দর মেয়ে হিসেবেই সে রয়ে গেল আমার
মনে।আমি যদিও ইতি কে কিছুই
দিই নি কোনোদিন।আর সেটা খুব খারাপও দেখায় তাই ইচ্ছে হলেও দিতে পারিনি।এরকম ভাবেই চলতে থাকলো আমার সময় আর ইতির বলা
হরেক রকম গল্প।আর তার সাথে
আমার মনের মাধুরী - লুচি আর হালুয়া।
এসবের বাদ সাধলো সেই বছরের পুজোর ঠিক আগে।কলকাতার এক
ইস্কুলে আমার বদলির ডাক এলো।সাথে
মাইনে টাও বাড়লো।মনে মনে খুশি হলাম।এই আগাছার গ্রাম থেকে নিস্তার পাবো।সারাদিন শুধু মশার উপদ্রপ।কিন্তু পুরুষের মন
বলে কথা,পিছু
টান দিলো ইতির
মুখ খানি।শেষ দিন যখন গেলাম ওই বাড়িতে সে যে কি বিষণ্ন মুখ তার তা বলে বোঝানো যায়না।যেন তাকে পাঠানো হচ্ছে কালাপানি তে।তবে
আসার আগে সে বললো-
-আর কি কোনোদিন আসবেনা , মাস্টার মশাই?
কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই তবে সেই
উত্তরে খুব যে আশার বাণী ছিল তা বলা যায়না।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে।আমায় ছাদনাতলায় একবার যেতেও হয় আর
সেই সুবাদে এক কন্যা সন্তানের
আবির্ভাব হয় আমাদের জীবনে।স্ত্রী,সন্তান
নিয়ে হৈ হৈ করে জীবন কাটতে
থাকে।কিন্তু ইতি কে কখনোই ভুলতে পারিনি।খুব মনে পড়তো।আর যখনই মনে পড়তো ওই আতরের গন্ধটা পেতাম।মনের সুখে সেই গন্ধ
উপভোগ করতাম।যদিও আমাদের বাড়িটাও
বড়বাজারের খুব কাছেই ছিল।
এরপর ঘটলো সেই ঘটনা যার জন্য এই গল্প বলা।আমার মেয়ের বয়স
তখন পাঁচ মাস।গড়ের মাঠে
ঘুরতে গেছিলাম স্ত্রী কে নিয়ে,কোলে
আমাদের মালতি।ফিরতে রাত হয়।বাড়ি ফিরে
হাত মুখ ধুয়ে বসেছি ইশকুলের খাতা দেখবো বলে আর তখনই দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো।দরজা খুলে দেখি -
ইতি।সেই
রূপ,সেই
চেহারা।তবে বয়সটা একটু হলেও বোঝা যায়।ভিতরে আসতে বললাম কিন্তু এলোনা।বললো-
-এই মাসের
শুক্ল পক্ষে আমার জন্মদিন।আর তার পরেই বিয়ে।এত বছর তো এলেন না,এবার না
হয় একবার পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন।আপনার আশীর্বাদ
কাম্য রইলো।
বলেই
ঢিপ করে একটা নমস্কার করে চলে গেল।বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।পরে ঘরে ফিরে স্ত্রী কে
সব বললাম।সেও বললো আমার যাওয়া উচিত।
ঠিক দশ দিন পর উল্লেখ্য দিন এলো আর আমি রওনা হলাম সেই
ভাটপাড়া জমিদার বাড়ির উদ্যেশে।
সঙ্গে নিলাম সেই আতর যা ইতির ভালোলাগে।সেখানে পৌঁছাতে একটু বিকেল হয়ে গেল।রাতের ট্রেনেই ফিরতে হবে তাই পরি মরি করে
ছুটলাম স্টেশন থেকে।জমিদার
বাড়ির সামনে এসে পুরো থ হয়ে গেলাম।সেই জৌলুস নেই বাড়ির।পুরোনো চুন সুরকি খসে খসে পড়ছে।চারিদিকে শুধু গাছ আর
গাছ।যাইহোক,ভিতরে
ঢুকলাম প্রকান্ড
এক লোহার দরজা ঠেলে।সদর দরজার কাছে আসতেই একজন বয়স্ক মানুষ বেরিয়ে এলো।নিজের পরিচয় দিলাম।তিনিও চিনতে পারলেন।ইনি সেই
গোসাই সাহেব।বললেন,জমিদার মারা গেছেন তার সাথে তার জমিদারি ও মারা
গেছে।এখন ওই খান
পাঁচেক বাগান আর কিছু জমি।এসব থেকে যা আসে তাতেই চলে।এবাড়িতে উনি ছাড়া আর কেউ নেই।আমি বললাম,সে
কি ইতি! সে কোথায়!
গোসাই
সাহেব স্থির নজরে আমার দিকে তাকায় আর বলে-
- ও বুজলাম।আপনাকেও ডেকেছে বুঝি!সত্যি মেয়েটাকে নিয়ে
আর পারা গেলোনা।আপনি যে বছর
চলে গেলেন সেই বছরই কালা জ্বরে সেও মারা যায়।ঘুমের ঘোরে শুধু বলতো 'মাস্টার মশাই'। আমার কাছে তার পর প্রায় আসতো আর
আপনার ঠিকানা চাইতো।একদিন আমিও
গেলাম কলকাতায় আপনার বাড়ি খুঁজতে।পেয়েও গেলাম।আপনার ইশকুল থেকেই দিলো ঠিকানাটা।কিন্তু ভাবলাম আমায় চিনবেন কিনা তাই আর
গেলাম না আপনার বাড়ি।এদিকে বাড়ি
ফেরার পথে এক সাহেব এর কুকুর আমায় কামরায়।চার দিন ওই কোন এক কলকাতার হাসপাতালে পরে ছিলাম।ওখানেই আসতো ইতি।ঠিকানাটা
ওখানেই দিলাম ওকে।এত বড় শহর তাই
হয়তো খুঁজে পেতে ওর সময় লাগলো।আমি তো আবার পঞ্চম দিনেই চোখ বুজলাম।
এরপর আর কিছুই কানে যায়নি।যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম ওখানেই
পরে আছি,কি
ভাবে বাড়ি ফিরলাম
আজও জানি না।তবে গোসাই এর কথা শুনতে শুনতে একবার পিছনের দরজার দিকে চোখ গেছিলো।কে যেন দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার
হাতের ওই আতরের শিশির দিকে।হয়তো
ইতি!!!!
No comments:
Post a Comment