অণুগল্প -
এক
রাতের অভিজ্ঞতা
সদ্য এস.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করে বিদ্যালয়ে অংকের শিক্ষকের চাকরিটা পেয়েছি। প্রথমেই পোস্টিং পড়লো উত্তরবঙ্গের এক গ্রামে। কলকাতা শহর থেকে তাই চলে এলাম এই গ্রামে।
প্রথমদিন যুক্ত হওয়ার পরে বিদ্যালয়েরই একজন পুরোনো
শিক্ষক আমাকে একটা বাড়ি ভাড়াতে ঠিক করে দিলেন। বিদ্যালয়ের একদম কাছেই, বাড়িটার বারান্দা থেকে পুরো বিদ্যালয়টাই দেখা যায়।
একদিনের মধ্যেই এত ভালো জায়গায় ভাড়ায় ঘর পাবো ভাবিনি। এই বাড়ির মালিক থাকেন শিলিগুড়িতে। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক বাড়িওয়ালার সাথে ফোনে কথা বলে সব ঠিকঠাক করিয়ে দিলেন। বাড়িটায় একটা বড় ঘর, রান্নাঘর আর বারান্দা আছে। বারান্দা দিয়ে দুই সিঁড়ি নেমে ডানদিকে বাথরুম। তার পাশেই কুয়োর পাড়। নিজের বাড়িতে বাথরুমের জন্য কখনো বাড়ির বাইরে যেতে না হলেও আমি সবকিছুতেই মানিয়ে নিতে পারি।
আমি বাড়িতে ঢুকে জিনিসপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। আমার কাছে জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই নেই। আগামীকাল এখানে থাকার জন্য আরোও অনেককিছু কিনতে হবে। দুদিন পাশের বাড়ি থেকেই খাওয়ার দেবে বলেছে।
আমি হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পালটে বসতেই দরজায় টোকা পড়লো। আমি "কে?"
জিজ্ঞেস করতেই পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের গলা,
"আমি রথীন। তোমার খাবাটা এনেছিলাম।"
"আসুন
না ভেতরে।"
আমি দরজা খুলে বললাম।
রথীনবাবু আমার হাতে একটা বড় থালা অন্য আরেকটা থালা দিয়ে ঢাকা অবস্থায় এগিয়ে দিয়ে বললেন,
"আজ আর আসবো না গো। অনেক রাত হয়েছে। গিন্নি খাওয়ার বাড়ছে। তুমিও খেয়ে নাও,
গরম আছে।"
"আচ্ছা
ঠিক আছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।"
"আরে, এতে ধন্যবাদের কিছুই নেই। মানুষই তো মানুষের সাহায্য করে।"
"সেই!"
"আজ
আসি ভায়া।"
"আসুন।"
লোকটা চলে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে থালাটা মেঝেতে রেখে বসলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম,
নয়টা বাজে। এমনিতে আমার দশটার আগে খাওয়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু গ্রামে তো নয়টা মানেই গভীর রাত। দেরী করলে খাওয়ারটাও ঠান্ডা হয়ে যাবে ভেবে খাওয়া শুরু করলাম। পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা অনেক কিছু রান্না করেছেন। ভাত,
পালং শাক,
মুসুর ডাল,
পাপড় ভাজা,
ফুলকপির তরকারি আর রুই মাছের ঝোল। পেট পুড়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে কুয়োর পাড় থেকে থালা-বাটি-গ্লাস ধুয়ে, নিজেও হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এলাম।
মেঝেতেই একটা চাদর পেতে শোওয়ার ব্যবস্থা করলাম। একটা রাত তো এভাবে কাটাতেই হবে। শোওয়ার আগে একবার বাথরুমে গেলাম। বাথরুম করে ফিরতেই হঠাৎ চোখ পড়লো বিদ্যালয়ের দিকে। দেখলাম একটা বাচ্চা বিদ্যালয়ের বড় লোহার গেট টপকে ঢুকে গেল।
"এত
রাতে বাচ্চাটা কি করছে?"
আমার মনে অদ্ভুত প্রশ্ন জাগলো।
আমার সাহসটা বরাবরই একটু বেশি। ঘরের দরজা আটকে দিয়ে মোবাইলটা শুধু নিয়ে এগিয়ে চললাম বিদ্যালয়ের দিকে। আমিও লোহার গেটটা টপকে ভেতরে ঢুকলাম। বিদ্যালয় প্রাঙ্গনের চারপাশে মোবাইলের টর্চ মারতেই হঠাৎ চোখে পড়লো,
একটা বাচ্চা গাছের তলায় লুকিয়ে আছে।
"এত
রাতে এখানে কি করছিস?"
আমি বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম।
"বাবা, আমাকে কাল সকালে শহরে পাঁঠিয়ে দেবে কাজের জন্য। তাই এখানে এসে লুকিয়েছি। আমি পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করতে চাই না।"
বাচ্চাটা বললো।
"নাম
কি তোর?"
"অসিত।"
"তুই
এখন বাড়ি যা। কাল সকালে তোর বাবাকে নিয়ে বিদ্যালয়ে এসে আমার সাথে দেখা করবি। আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলবো, তোকে কাজে পাঠাবে না।"
"সত্যি
মাস্টারমশাই?"
"একদম
সত্যি!"
বাচ্চাটা চলে গেলে আমিও নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছালাম। কিন্তু সারাদিনে বাচ্চাটা এলো না। শেষে আমাকে যে বাড়ি ভাড়া ঠিক করিয়ে দিয়েছিল তাকেই পুরো ঘটনাটা জানালাম। পুরো ঘটনা শুনে সে আঁতকে উঠলো।
অসিত নামের ওই ছেলেটা দুই বছর আগেই মারা গেছে। এক রাতে ও এরকম ভাবে সত্যিই বিদ্যালয়ে চলে এসেছিল। আর গতকাল রাতে ঠিক আমি ওকে যা বলেছিলাম, তখন অন্য এক শিক্ষক যে আমার ঘরটাতেই ভাড়া থাকতো,
সেও একই কথা ওকে বলেছিল। কিন্তু অসিত বাড়ি ফেরার পর ওর বাবা ওকে খুব মারধর করেন আর তাতেই ও মারা যায়। তারপর থেকেই ওর আত্মা বিদ্যালয়ের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। শিক্ষকতা করতে এসে প্রথম রাতেই এমন অভিজ্ঞতা হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
No comments:
Post a Comment