Monday, January 14, 2019

মৌ দাশগুপ্ত



অণুগল্প -
সদভুত-সবভুত

ভুত-১ : ছায়া
রাতে একা ঘরে বড্ড ভয় করে, আমার আবার খুব ভুতের ভয়। দিনের বেলায় একা থাকতে ভালোই লাগে। আসলে এ বাড়িতে লোকজন কেউ তেমন আসেই না। আজ সকালে দোতলার পুবের জানলাটা জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলতেই নজরে এল আগাছা ঘেরা জংলা বাগানে লাল টকটকে একটা গোলাপ ফুটেছে। বাবা বেঁচে থাকতে বাগানটার নামই ছিল গোলাপবাগান। কত বাহারী গোলাপ ফুটতো তখন। আমি ওসব বাগানের কাজ-টাজ পারি না, তাই বাগান এখন জঙ্গল। কেউ দেখার আগেই তুলে নিয়ে এসেছি ফুলটা। বাবা গোলাপ বড় ভালবাসতেন, আদর করে আমায় ডাকতেন "গোলাপবালা"। অনেকদিন পর চুলে গোলাপ গোঁজার শখ হল। ঐ তো আয়নাটা ঝুলছে দেওয়ালের গায়ে, দেখি কেমন লাগছে আমায় ! সামনে দাঁড়াতেই বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত হয়ে ঘরের এ-প্রান্ত থেকে ও -প্রান্তে হু-হু করে বয়ে গেল। ভুলেই গেছিলাম আয়নায় এখন আর আমার ছায়া পড়ে না।

ভুত -২ : অদৃষ্ট
সকাল থেকে পায়ের যন্ত্রণা, না ঠিক যন্ত্রণা নয়, আগুনে পোড়ার মত তীব্র জ্বালাটা বড্ড ভোগাচ্ছে। তখন থেকে বাড়ির পিছনের ডোবায় পা ডুবিয়ে বসে আছি, একটুও কমছে না। কেন যে মরতে জেদ করে এ বাড়িতে এসেছিলাম। আসলে খবরের কাগজে এই বাড়িটার ব্যাপারে প্রতিবেদনটাই এর জন্য দায়ী। যাক ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে গেলেই বাঁচি।ভাগ্যিস রিক্সায়ালাটাকে বলে এসেছিলাম সকালে এসে স্টেশনে নিয়ে যাবার জন্য। পায়ের যা অবস্থা, একদম হাটতে পারছিনা। ব্যাটার কাল যা ফেরত যাবার তাড়া ছিল,কোনওরকমে নামিয়ে দিয়েই রিক্সা ঘুরিয়ে দে ছুট! এখন আবার কখন আসে দেখি, সুর্য তো প্রায় মাথার ওপর এসে গেছে। ভাবতে ভাবতেই হাল্কা চেঁচামেচি শুনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দক্ষিনের ঘরটায় গিয়ে দেখি, সেই রিক্সায়ালা, সাথে আরো দু তিনজন, সবাই মিলে উত্তেজিত ভাবে কি যে বলছে বুঝতেই পারছিনা। কি দেখে এত চেঁচামেচি দেখতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা চেনা মানুষটার দিকে নজর গেল। সাপে কেটেছে। একটু আগে ধরাধরি করে বডিটা ওরা বার করে নিয়ে গেল, ব্যাগ ঘেঁটে টাকাপয়সা, মোবাইল, ভোটার আই ডিও বার করে নিয়ে গেছে। বাকি যা ছিল লন্ডভন্ড হয়ে মেঝেয় পড়ে আছে। সাবধানে তুলে গুছিয়ে রাখতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম। আমার তো আর কোথাও যাবার নেই!

ভুত -৩ : নিশিগান
অফিসের কাজে তিনদিনের জন্য এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরে এসেছি। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, ছড়ানো ছিটানো, ইঁটের বাড়ি কম। কাল সন্ধ্যায় বাস থেকে নেমে এ টুকুই চোখে পড়েছে, মন্দ লাগেনি। খালি বড় নির্জন জায়গাটা। কম্পানীর অফিসিয়াল গেস্টহাউস সবে তৈরী হচ্ছে,একটা ঘর, বাথরুম আর কিচেন, কাজ চালানো এরেঞ্জমেন্ট। এখানকার অফিস বেয়ারা জিনিষপত্র নামিয়ে ঘর ঝাঁটপাট দিয়ে জল, ডিনার দিয়ে গেছিল। লোডশেডিং বিশেষ হয় না, তবু ইনভার্টর আছে, খালি ব্যাটা ফেরত যাবার মুখে রাতে জানলা দরজা খোলা রাখতে বারন করে গেছিল। মাঝেমধ্যে নেকড়ে নেমে আসে নাকি। আমি শহুরে মানুষ, ওই রকম অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতায় এমনিতেই ঘাবড়ে অস্থির, তার ওপর নেকড়ে! কত রাত অব্ধি আলো-টালো জ্বেলে জেগে বসেছিলাম মনে নেই, শেষে ডানদিকের বাড়িটায় বেশ জোরে গীটার ব্যাঞ্জো ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে সম্মিলিত গলায় অজানা ভাষায় গান-টান স্টার্ট হবার পর মনে-মনে ভরসা পেয়ে সেই যে ঘুমিয়েছি, সকালে অফিসবেয়ারাটি এসে বেড-টি দিয়ে ঘুম না ভাঙ্গালে আরো টেনে দিতাম। অথচ আজ রাতে সেই গানের আওয়াজেই সারা ঘরে আলো জ্বালিয়ে কাঠ হয়ে বসে আছি বিছানায়। কেননা, আজ দিনের বেলাতেই দেখে নিয়েছি এ বাড়ির ডানদিকে কোন বাড়ি ঘর নেই, শুধুই অতলস্পর্শী খাদ।


No comments:

Post a Comment