অণুগল্প -
শেষযাত্রা
সয়েল সার্ভের কাজে
গেছি বিহারের আরায়। গ্রামেগঞ্জে কাজ আমাদের। খেতিজমিনের ফার্টিলিটি স্ট্যাটাস
যাচাই করে সরকারী রিপোর্ট বানাই। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে বৈশাখের হাড়জ্বালানি গরমে
ঘুটিয়ারীচক।আমার কাজ ছড়ি ঘোরানো। গরমে তাও ভালো লাগছে না বলে প্রায় শুকিয়ে আসা
নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি গ্রাম ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দুরে।সামনে
খোলামাঠ। প্রায়বিকালের রোদেও কেমন ধোঁয়াধোঁয়া লাগছে।ধু-ধু মাঠের পাশে এক
বটগাছ।ছায়া দেখে তলায় বসে ঝিমোচ্ছি। ঢকঢক করে জল ঢালছি গলায়। হঠাৎ খেয়াল করলাম
মাঠের মাঝে ধীরে এগিয়ে আসছে একটা মানুষ। পুরুষ কি স্ত্রী ঠাহর করা মুশকিল।অতি
কষ্টে টেনে আনছে একটা চৌকো বাক্সমত কি। কাছে আসতে বুঝলাম অল্পবয়সী একটি
মেয়ে।মাথামুখ মলিন ওড়নায় ঢাকা,পরিধানের সালোয়ারটির
অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। না ও একা নয়, ওর সাথে চারচাকা লাগানো কাপড়ঢাকা
প্যাকিংবাক্সটা টানছে একটা বাদামী নেড়ি কুকুর আর সাদা একটা রামছাগল।আমাকে দেখে
বিচিত্র প্রসেসনটা থমকে দাঁড়ালো।এগিয়ে গেলাম সেদিকে ।বাক্সে এক হাড় জিরজিরে বুড়ো
মানুষের মড়া শোয়ানো,
মুখটুকু শুধু খোলা।একটা বিশ্রী পচা গন্ধ ছড়িয়ে
পড়েছে চারপাশে।বমি আসছে যেন।
জিজ্ঞেস করলাম,
- ''কে তোমরা? কোথায় বাড়ি তোমাদের ? কে মরেছে ?''
জীর্ণ ওড়নায় মুখ
কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সে জানাল,
- ''হম কুসুম হ্যায় জি। হমরা ঘর কাঁহা।হম তো
বেদিয়া হ্যায়। ইয়ে হমরা বাপু হ্যায় জি।“ ।
ওরা বেদে। কুষ্ঠরোগ
হয়েছিল বলে বাপ-বেটি দলছাড়া হয়েছে অনেকদিন আগে। কোন গ্রামেও ঠাঁই হয়নি।গতরাতে বাপ
মরার পর কুসুম একাই বাপের মরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীচরের অন্ত্যজদের কবরখানায়।কথা
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। কবরখানা কাছেই। একটু আগেই পাস কাটিয়ে এসেছি। আমার
বাবা মারা গেছেন আজ ২০ বছর হল।মেয়ে বলে শেষযাত্রায় শববহনে হাত লাগাতে পারিনি। শুধু
মুখাগ্নিটুকু করেছিলাম। হঠাৎ যেন সেই সদ্য পিতৃহারা সন্তানের অনুভূতিটা ফিরে
পেলাম। কথা না বাড়িয়ে কুসুমের সাথে দড়িতে হাত লাগালাম। ও অবাক হল কিন্তু আপত্তি
করলো না। শুকনো দুঃখীমুখ জুড়ে হাজার ওয়াটের হাসি ফুটিয়ে পা বাড়ালো কবরখানার দিকে।
সাথে আমি আর দুটি অবোলা প্রাণী। দড়িটা টানতে টানতে যাচ্ছি, আসার সময় কবরখানাটা
দেখেছিলাম। বেশীদূর নয়। কিন্তু এখন যেন পথটা ফুরাচ্ছেইনা। টানছি তো টানছি।এই গরমে
হাঁটার জন্য কিনা জানিনা,
বাক্সটাও ক্রমশ ভারী লাগছে। পচা গন্ধটাও ক্রমশঃ
উগ্র হয়ে উঠছে। সূর্য্যও ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। গাছের ছায়া আরো লম্বা হয়ে পথের ওপর পড়া
আলোকে আড়াল করতে চাইছে।হঠাৎ খেয়াল হল বিকেল-রোদে পথের ওপর গাছের ছায়া, আমার ছায়া, কিন্তু আমার
সঙ্গীদের ছায়া তো কই দেখছিনা। খেয়াল করামাত্র শিঁরদাড়া দিয়ে বরফগলা রক্তস্রোত বয়ে
গল যেন। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। কান গরম, হাজার ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছি।হাতের তালু পায়ের
পাতায় ঝিমধরা অনুভূতি।নিজের অজান্তেই দড়ি ছেড়ে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে
পড়েছিলাম।খানিকটা এগিয়ে তাই বুঝি ঘুরে দাঁড়ালো কুসুম।অথবা কুসুমের পচা গলা মাংসে
ঢাকা কঙ্কাল!চোখের সামনে সব আবছা হয়ে দুলে উঠলো।তারপর আর কিছু মনে নেই।জ্ঞান ফিরলো
হাসপাতালে। আমায় সার্ভেক্যাম্প না পেয়ে আমার অ্যাসিস্টেন্ট যতীন দু’তিনজন লোক নিয়ে
খুঁজতে বেরিয়েছিল।বড়খাইবিলের পাশের লাল মেঠো রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম। ওরা ধরেই
নিয়েছে কোলকাত্তাইয়া শহুরে ম্যাডামজি গরমের চোটে ভিরমি খেয়েছে। আমিও আর কাউকে কিছু
বলিনি তবে শরীর খারাপের অজুহাতে সেদিনই সার্ভের কাজপাট শিকেয় তুলে পাটনায় ফিরে
এসেছিলাম।
No comments:
Post a Comment