অণুগল্প -
ছাদ
গতবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা পাঁচজন বন্ধু
মিলে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। রাজেশ,রণিত,আমি(প্রিয়াঙ্কা),সুস্মিতা, দীপক আমরা এই পাঁচজন শৈশব সঙ্গী। গ্রাজুয়েশনের
হাঁসফাঁসানি চাপ থেকে মুক্ত
হবার পর বন্ধুরা
মিলে ঘুরতে যাওয়াটাই ছিল আমাদের কাছে স্বস্তির নিঃশ্বাস,বিশ্রাম,জেলখানা থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রাণ ফিরে
পাওয়া।খড়গপুরে আমার আর সুস্মিতার বাড়ি।সেখান থেকে হাওড়া
স্টেশনে এসে সবাই একসাথে মিলিত হয়ে
পুরীর ট্রেনে উঠলাম।
পরের দিন বেলা ১০টার দিকে আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে গিয়ে উঠলাম।হোটেলটা জনারণ্যের কোলাহল থেকে
একটু দূরে ছিল।সুস্মিতা, দীপক,রাজেশ একটু ফাঁকা জায়গা পছন্দ করে।তাই ওরা
সাত দিন কাটানোর জন্য এই হোটেলটাই বেছে
নিয়েছিল।হোটেলের দারোয়ান আমাদের সাদর
আমন্ত্রণ জানিয়ে
ভেতরে নিয়ে গেলেন।আমাদের দুটি রুমের চাবি হাতে দিয়ে ঘরগুলো দেখিয়ে দিলেন।সাজানো গোছানো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নই ছিল দুটি ঘর।হোটেলটির দোতলায় আমাদের রুম দেওয়া হয়েছিল,বাইরের বারান্দা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত।আমাদের সকলেরই বেশ পছন্দ হয়েছিল। তবে হোটেলের মালিক বলে দিয়েছিল“আমরা রাত্রি ১০টার আগে এখান থেকে বেরিয়ে যাই।আর
দাদাবাবু,দিদিমণি তুমাদেরকেও একটা কতা বলচি রাত্তি ১১টার মদ্যি সব্বাই যে যার নিজের ঘরে ঢুকে
যাবে।বাইরে থাকবে না"।আমি বরাবরই বেশ ভীতু।কথাটা
শুনে আমার গাটা ছ্যাঁত করে
উঠল।আমাদের সবার
মধ্যে রণিতের মাথাটা একটু বেশি গরম।ও রেগে গিয়ে বলে বসল-“এই দেখো কাকা প্লিস বেশি জ্ঞান দিতে এসো
না।বাড়ির লোকের মত বলোনা,নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাড়ি ফিরবি।দেখো বাড়ি
থেকে বেরিয়ে আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি।চুপচাপ বসে থাকতে আসিনি।”তাঁদের মধ্যে একজন বয়স্ক লোক রণিতকে উদ্দ্যেশ করে আমাদের সবাইকে বলল-“যদি প্রাণে বাঁচতে চাও,রাত ১১টার মধ্যে যে
যার ঘরে ঢুকে
যেও।তারপর সকাল না হওয়া পর্যন্ত দরজা খুলবেনা।আর হ্যাঁ সন্ধ্যের পরে কেউ ছাদে যাবে না।"বলে ওরা চলে গেলেন।আমরা যথারীতি
সমুদ্র স্নানের জন্য রওনা দিলাম।হৈহৈ করে স্নান
সেরে ঝিনুক কুড়িয়ে বেলা সাড়ে
বারোটা নাগাদ হোটেলে
ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে সবাই মিলে আমাদের জন্য বরাদ্দ ঘরের একটাতে বসে গল্প করছিলাম।
আমাদের মধ্যে রাজেশ,রণিত একটু বেশি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। রহস্য
কার না ভালো লাগে?আমরাও রহস্য উদঘাটন করতে বেশ ভালোবাসি।তবে
ওদের মতো অত বেশি দুঃসাহসী
আমরা নই।আমরা সেখানে
বসে ভূতের গল্প করছিলাম।পরের বার কোন ভূতুড়ে জায়গায় ঘুরতে যাব-এরকম ধরনের কথাই আলোচনা করছিলাম।দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে
বিকেল হল।সূর্যের রক্তিম আভা সমুদ্রতটকে রাঙিয়ে
তুলল ধীরে ধীরে।বারান্দা থেকে বসে
বসে এই দৃশ্য দেখতে
দেখতে প্রকৃতের সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে
ফেলেছিলাম।তারপর
সুস্মিতার ডাকে সম্বিত ফিরল,সবাই মিলে তৈরি হয়ে রওনা দিলাম চারপাশ ঘুরে আসার জন্য।সমস্ত দিক ঘুরে
বাইরে হোটেলেই রাতের খাবার সেরে
হোটেল ‘মনোহর’এ গিয়ে উঠলাম।তখন রাত ১০টা বেজে ৩০
মিনিট।হোটেলে কেউ কোত্থাও
নেই।শুধু আমরাই ক’জন।আমি,সুস্মিতা একটা ঘরে ঢুকলাম রাতের বিশ্রামের জন্য।রণিত,রাজেশ আর দীপক অন্য ঘরে শুয়ে পড়ল।সারাদিন
ঘোরাঘুরির পর ক্লান্তিতে চোখটা বুজে আসছিল।হঠাৎঘুমটা
ভেঙে গেল একটা নূপুর পরা পায়ের
শব্দে।প্রথমে শব্দটা
ছাদ থেকে আসছিল।ছাদের মধ্যে কেউ যেন খুব ধীরে ধীরে একদিক থেকে আর একদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে।ধীরে ধীরে সেই পায়ের শব্দটা নীচের
দিকে নেমে আসতে থাকল।আমাদের দরজার কাছে পর্যন্ত
এসে থেমে গেল।ঘড়িতে তখন রাত্রি
১১টা বেজে ১৫ মিনিট।
তারপর আস্তে আস্তে পায়ের শব্দটা ধীরে ধীরে কমতে কমতে ছাদের দিকে উঠতে থাকল।তার ঠিক খানিক বাদেই ছাদ থেকে শোনা গেল-“বাঁচাও আমায় বাঁচাও।”আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।বিছানা থেকে
উঠে যে জলটুকু খাব সে শক্তিও হারিয়ে গেছে।তারপর কখন ঘুমিয়ে
পড়েছি জানিনা।সকালবেলা দীপক আর
সুস্মিতার ডাকে ঘুম
ভাঙল।
রণিত,রাজেশকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।আমিও উঠে ওদের সাথে একটু খুঁজলাম।কোথাও পেলাম
না।তখন ঘড়ির কাঁটায়
সকাল ৬টা।এত সকালে উঠে ঘুরতে বেড়োনোর মতো ছেলে ওরা নয়।আমার হঠাৎ মনে হল একবার ছাদে গিয়ে দেখে আসি।সুস্মিতা,দীপকও আমার সাথে
গিয়েছিল।ছাদে গিয়ে
যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু ছানাবড়া।চিৎকার করে কাঁদতে চাইলেও কাঁদতে পারছিনা।দেখি রণিত,রাজেশ পাশাপাশি শুয়ে আছে।চোখগুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।কেউ যেন শ্বাসরুদ্ধ করে ওদের
খুন করেছে।তারপর আমার আর কিছু
মনে নেই। যখন জ্ঞান
ফেরে,তখন চোখ খুলে দেখি সুস্মিতা আর দীপক মাথার
কাছে বসে আছে।ডাক্তারবাবু আমাকে দেখে কিছু ঔষধ
দিলেন।কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিতে
বললেন।কিন্তু আমি আর
একটা দিনও সেখানে থাকতে চাইনি।তবে হোটেলের মালিকের কাছ থেকে আমরা জানতে চাইলাম এই দুর্ঘটনার কারণ। উনি যেটা বললেন,বছরখানেক আগে
এক দম্পতি এখানে
এসেছিলেন।আমি,সুস্মিতা যে ঘরে গত রাত্রে শুয়েছিলাম, ওই ঘরেই তাঁরা ছিলেন
কিন্তু একদিন তাঁদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।তখন মিঃ ব্যানার্জি,
মিসেস ব্যানার্জিকে
শ্বাস রোধ করে খুন করে।এবং আত্মহত্যা বলে
প্রমাণ করবার জন্য
মৃতদেহ ছাদে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে নীচে ফেলে দেন আর ঘটনাটি ঘটেছিল রাত্রি ১১টা নাগাদ।শীতকাল হওয়ায় এখানটা তখন নির্জন
ছিল।তখনই এই ঘটনা ঘটে।তারপর থেকেই ওর অতৃপ্ত আত্মা
সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়।যারা ওই ছাদের
দরজা খুলে তাকে
বাঁচানোর চেষ্টা করে তাদেরই নিজের দলে টেনে নেয়।এসব কথা জানার পর আর এক মুহূর্তও আমরা থাকিনি সেখানে।রাজেশ,রণিতের দেহ স্বর্গ
দুয়ারে দাহ করে এক
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরি।
No comments:
Post a Comment