গল্প -
ভূতুড়ে ঝড়
দিবাকর বলল, “রাজামশাই? এ
অঞ্চলে এখনো রাজা-টাজা আছেন নাকি ?”
লোকটি বলল, “না এখন নেই, তবে তাঁর দেওয়া নির্দেশ তো আছে ? রাজার
আদেশ শিরোধার্য। অমান্য করা যায় না। তাছাড়া রাজামশাই না থাকলেও তাঁর রেখে যাওয়া
এই তলোয়ার আর রাজমুকুট আমার সঙ্গেই আছে। বলতে পারেন আমি তাদেরকেই বাঁশি শোনাই।
তাছাড়া আমার আরো একজন সঙ্গী আছে, রাজামশাইয়ের প্রিয় বাজপাখি। ”
লোকটি আবার আপন মনে বাঁশি বাজাতে লাগল।। বাঁশি বাজাতে বাজাতে মাটিতে মৃদু
ভাবে পা ঠুকছে আর বিচিত্র ভঙ্গীতে শরীরটাকে নাচাচ্ছে। দিবাকর সেই লোকটিকে দেখে
অবাক হয়ে গেছে।
লোকটি বাঁশি বাজানো বন্ধ করতেই দিবাকর
আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি রোজই এভাবে বাঁশি বাজান?”
লোকটি এবার মাথার ঘাম মুছে বাঁ হাতে
বাঁশিটি রেখে বলল, “না রোজ বাজাই না। ফাল্গুণ পূর্ণিমার
রাতে যেদিন আকাশে এক ফোঁটাও মেঘ থাকে না সেদিনই কেবল বাঁশি বাজাই। এটাও রাজামশাইয়েরই
সেরকমই নির্দেশ।”
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ নাগাদ মহকুমা
শহর থেকে পনেরো মাইল দূরে তালডাংরা মৌজায় ডুংরি ও টিলা বেষ্টিত বিশার মাঠের এক
দিকে তাবু ফেলা হল। সঙ্গে রয়েছে
টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার সন্ন্যাসীবাবু, হেড ড্রাফটসম্যান গিরিবাবু, দু-জন চেন পিয়ন
আর একজন রাঁধুনি-কাম-অন্যান্য ফাইফরমাস খাটার লোক মহাবীর সহিস।
সদ্য আমিন পদে যোগ দিয়েছে দিবাকর। কাজে
নেমে পড়ার আগে এক মাস মাঠে-ঘাটে ট্রেনিং নিতে হবে তাকে। টারসিয়ারি পয়েন্ট ধরে ধরে
জমি জরিপের কাজ ভালোভাবে শিখে নিতে পারলে তবেই কাজে দক্ষতা বাড়বে। মাঠ-জরিপের
নকশা ইঞ্চিতে পরিবর্তিত করে খাতার পাতায় তুলে ফেলতে পারলে তবেই ট্রেনিং পর্বটি
সমাপ্ত হবে।
যেখানে তাবু ফেলা হল তার পূর্বদিকে পর
পর ছোট টিলার সারি। দুটি বড় টিলার মাঝখানে অনেক পুরনো একটি জরাজীর্ন বাড়ি মাটির
সঙ্গে মিশে গেছে। পুরনো বাড়িটির দরজা জানালা অনেকদিন আগেই খুলে পড়েছে।
বট-অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে টিকে থাকা পাঁচিলের গা বেয়ে। ভেঙ্গে পড়া বাড়িটার পাশে
বেশ কয়েকটি ঝাপুড়-ঝুপুড় তমাল গাছের সারি। তবে গাছে একটাও পাতা নেই, সব পাতা ঝরে
গিয়ে মাঠে ছড়িয়ে গেছে। আর রয়েছে সারা মাঠ জুড়ে প্রচুর পলাশ গাছ। এখন পলাশ গাছেও
পাতা নেই, শুধু ফুল আর ফুল।
সবে সন্ধ্যা নেমেছে। দিবাকর একটি উঁচু ঢিবির উপর বসে
সূর্যাস্ত দেখল। সূর্য ডোবার পরেও অনেক আলো আকাশে রয়ে গেছে। সেই আলোয় ডানা মেলে
পাখিরা ঘরে ফিরে আসছে। দিবাকর তাবুতে না গিয়ে এখানেই চুপ করে বসে থাকল। মহাবীর
আরেক কাপ চা দিয়ে গেছে। একসময় ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলেও আকাশে চাঁদের আলো
উজ্জ্বল হল। সেই স্নিগ্ধ চাঁদের আলো উপভোগ করতে করতে দিবাকর চোখ বন্ধ করে ফেলল।
ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতেই একটু ঘুম
ঘুম এসছিল কিন্তু হঠাৎ করে মিষ্টি বাঁশির শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। তাবুর প্রবেশ
পথে মৃদু মোমের আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। চাঁদের আলোয় পথ-ঘাট, ঝোপ-জঙ্গল, দূরের
গাছ-গাছালি সবই চোখে পড়ছে। দিবাকর আড়মোড়া ভেঙ্গে বাঁশির সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে
চলল।
(২)
লোকটি বাঁশি হাতে নিয়ে অন্ধকারে গাছের
উপরের দিকটায় একবার চোখ চালাল। তারপর দিবাকরকে একটা অদ্ভূত ন্যাড়া গাছের কাছে
নিয়ে এল। এখন ফেব্রুয়ারির শেষ। আর কয়েকদিন পরেই এই ন্যাড়া গাছটি কচি সবুজ পাতায়
ভরে উঠবে।
লোকটি সেই গাছের ডালে সত্যি সত্যিই
একটি তলোয়ার দেখালো। চাঁদের আলো তলোয়ারের গায়ে পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। এ একেবারে সত্যি
রাজা-রাজড়াদের তলোয়ার না হয়ে যায় না।
দিবাকর আরো একটি জিনিস না দেখে থাকতে পারল না তা
হল একটি রাজ-মুকুট। সেটি থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে বলে দিবাকরের চোখ আপনাআপনি সেদিকেই
চলে গেল।
লোকটি কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলল, “কী রে ফজল, কখন এসেছিস ?”
দিবাকর দেখল ন্যাড়া গাছটির মগডালে কী
একটা পাখি চুপচাপ বসে আছে। নীচ থেকেই পাখিটার চোখ দুটো অত্যন্ত ক্রুর বলে মনে হল
দিবাকরের।
“পাখির চোখ কি ক্রুর
হতে পারে ?” নিজেকেই প্রশ্ন করল দিবাকর। পাখিটা যেন এখনই তার
শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এরকমভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দিবাকর আর সেটার দিকে
তাকাতে পারল না। চোখ সরিয়ে নিল।
লোকটি আবার বাঁশি বাজাতে লাগল। দু-পা
মাটিতে ঠুকে কোমর দুলিয়ে নেচে নেচে বাঁশি বাজাচ্ছে সে। চোখ দুটো বন্ধ করে একমনে
সুর দিচ্ছে বাঁশিতে। হাতের আঙ্গুল বাঁশির ছোট ছোট গর্তে দ্রুত ওঠানামা করছে। আর
তাতেই এক মায়াবি সুরের ঝংকার আছড়ে পড়ছে টিলা আর তার আশপাশ জুড়ে। দিবাকর এক
আশ্চর্য সুন্দর সুরের জগতে ঢুকে পড়ল। সে যেন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, শুধু
সুরের মায়া জাল তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। ক্রমে ক্রমে মস্তিষ্ক অচেতন করে দিচ্ছে।
তার মনে হচ্ছে সামনেই একটা ঝড় এসে গাছের শুকনো ডালপালা তছনছ করছে। শুকনো
খড়-কুটো, ধুলোবালি উড়ছে আকাশে। ঝড়টা খুব কাছেই এসে পড়েছে। হাজার হাজার শুকনো
পাতা একসময় মাটি থেকে এক লাফে শূন্যে উঠে করতালি বাজানোর মত শব্দ করে উঠল। বসে
থাকা বাজ পাখিটা অত্যন্ত কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল আর ডানা ঝাপটাতে লাগল। দিবাকর ধুলোর
পর্দায় লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে না। শুধু একটানা বাঁশির সুর তার কানে প্রবেশ করে কান
দুটোকে অবশ করে দিচ্ছে।
একসময় প্রবল ঝড় আছড়ে পড়ল। সেই
ঝড়ের ধাক্কায় কে কোথায় ছিটকে পড়ল। দিবাকর শুধু একবার মনে করতে পারল, “ঝড়ের ধাক্কায় তাদের তাবুটা কি উড়ে গেল?”
আর কিছু মনে নেই।
(৩)
কার্তিক সিংমুড়া বললেন, “একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল তিন বছর পর। ”
ক্যাম্পে একটি টিনের চেযারে বসে
কার্তিকবাবু দিবাকরের মুখোমুখি বসে আছেন। দিবাকর জ্ঞান হারিয়ে গাছের নীচে
পড়েছিলেন। মাঝরাতে মহাবীর অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে ওখানে পড়ে থাকতে দেখে। তারপর
সবাই মিলে ক্যাম্পে নিয়ে আসে।
দিবাকর সকালবেলা চোখ মেলে প্রথমেই বলে,
“যাক গতরাতের ঝড়ে তাবুর কোন ক্ষতি হয়নি তাহলে?”
তার কথা শুনে সকলে ভীষণ অবাক। রাত্রে
ঝড় বৃষ্টি কিছুই তো হয়নি। সারারাত নির্মেঘ আকাশে চাঁদ আলো ঢেলে গেছে। এরপর দিবাকর
বাঁশির কথা বললে গিরিবাবুরা আরো অবাক হয়। তাবুতে বসে তারা কেউ রাত্রে বাঁশির সুর
শুনতে পায়নি তো ?
কার্তিকবাবু পাশের একটি গ্রামে থাকেন।
টিলার কাছে কাদের তাবু পড়েছে সেটা জানতে তিনি সকাল বেলা হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে
পড়েছেন। এসেই যা শুনলেন তাতে তিনিও রোমাঞ্চিত হলেন।
তিনবছর আগে বেণু যা বলেছিল তা তিনি
বিশ্বাস করেননি। শুধু তিনি কেন গ্রামের কেউই বেণুর কথা বিশ্বাস করেনি। আসলে বেণু
ছেলেটা একটু ভবঘুরে ও পাগলাটে স্বভাবের বলেই হয়তো তার কথা কেউ তেমন ভাবে আমল
দেয়নি। কিন্তু এখন দেখছেন বেণু বাঁশিয়ালার যা বিবরণ দিয়েছিল তা দিবাকরবাবুর
বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আস্তে করে বললেন, “জোসেফ.. জোসেফ....।”
“এই টিলার পেছন দিকে
একটা জঙ্গল ঘেরা জায়গা রয়েছে। সেখানে অনেকগুলো পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ির একটায় জোসেফ
একাই থাকত। তার কাজ ছিল শুধু বাঁশি বাজানো। শোনা যায় সে নাকি এই অঞ্চলের রাজা
সোমেশ্বর সিংদেও-এর এস্টেটে চৌকিদারের কাজ করত। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতো বলে রাজা
সোমেশ্বর তাকে খুব স্নেহ করতেন। আসলে রাজামশাই নিজেও ছিলেন একজন সেতার বাদক। তাই
জোসেফ শুধুমাত্র রাখালিয়া বাঁশিতে সুর তুলেই রাজামশাইয়ের একজন প্রিয়পাত্র হয়ে
উঠেছিল। ফলে তাকে আর চৌকিদারের কাজ করতে হতনা। জোসেফের কাজ ছিল রাজামশাইয়কে বাঁশি
শুনিয়ে খুশি করা।
অনেক দিন আগের ঘটনা হলেও এখনো অনেকের
মনে আছে – এক ফাল্গুণ পূর্ণিমার রাত্রে ভয়ংকর ঝড়ে রাজামশাই গাছ চাপা পড়ে মারা
যান। সেদিন আকাশ ছিল নির্মেঘ। রাজামশাই খোলা আকাশের নীচে জোসেফের বাঁশি শুনছিলেন। নির্মেঘ আকাশ একসময় মেঘে ছেয়ে যায়।
শুরু হয় প্রচন্ড ধুলো-ঝড়। প্রকান্ড একটা গাছের ডাল সোজা তাঁর মাথায় এসে পড়ে। কাল রাত্রে দিবাকর বাবু যেখানে
শুয়েছিলেন ঠিক সেখানেই রাজামশাইয়ের দেহটা পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।
বেণুও একদিন মাঝরাতে বাঁশির সুর শুনে কৌতুহলবশতঃ সেখানে গিয়ে হাজির
হয়েছিল। বেণু বলেছিল ও নাকি মাঝরাতে প্রায়ই বাঁশির শব্দ শুনতে পেত। তাই সেই
বাঁশিওয়ালাকে স্বচক্ষে দেখতেই সে রাত্রে ওখানে চলে এসেছিল। একটানা কথাগুলো বলে
কার্তিকবাবু থামলেন।”
দিবাকর বলল, “বেণু রাজামশাইয়ের তলোয়ার, রাজমুকুট এসব কিছুর দেখা পেয়েছিল ?”
“কী জানি ! এই টিলার আশপাশ জুড়ে রাজাদের যে গড় ছিল তার ধ্বংসাবশেষ এখনো খুঁজে পাওয়া
যাবে। জোসেফ যে বাড়িটায় থাকতো তারও চিহ্ন পাওয়া যায় জঙ্গলের মাঝে। ভেঙ্গে পড়া
ইঁটের প্রাচীর মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। তবে রাজা-মহারাজাদের কত বিচিত্র গল্প ছড়িয়ে
রয়েছে এই মাঠ জুড়ে। কত অজানা সুর এখনো বাতাসে মিশে রয়েছে। ফাল্গুণ-পূর্ণিমা রাতের
সেই ভয়ংকর ঝড়ের কাহিনি এখনো উপলব্ধি করেন কেউ কেউ। বুড়ো জোসেফকে অনেকেই মাঝরাতে
বিষন্ন মনে মাথা নীচু করে হেঁটে যেতে দেখেছে। তবে সে নাকি আর বাঁশি বাজায় না বলেই
শুনেছিলাম। কিন্তু তাঁর বাঁশির সুর তো আপনি নিজের কানেই শুনেছেন।”
দিবাকর সেই বাঁশির সুর কোনদিন ভুলবে
না। সেই সুর তার মস্তিষ্কের কোষে কোষে মিশে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই সে জোসেফের
বাঁশির সুর শুনতে পাচ্ছে। আর দেখতে পাচ্ছে মাটিতে পা ঠুকে ঠুকে তার সেই বিচিত্র
নাচ। মনে হচ্ছে সে নেচেই চলেছে... নেচেই চলেছে। আরো কত বছর সে একই ভঙ্গীতে বাঁশিতে
সুর তুলবে আর পা ঠুকে ঠুকে নাচ করে যাবে তা কেউ জানে না....।
No comments:
Post a Comment