অণুগল্প -
ঋণশোধ
অনেকদিন হল এ' পথে আসা হয়নি৷যখন
এসছিলাম তখন এত কিছু গড়ে ওঠেনি৷আর আজ নগরায়ণের কল্যাণে মামুদপুরের চেহারাটাই
পাল্টে গেছে৷আমি,হরিশঙ্কর দত্ত,দৌলতাবাদ
উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক৷শিক্ষক হিসেবে আর কিছু না
পাই,প্রচুর ছাত্রের ভালোবাসা পেয়েছি৷আমার অবসরের দিন গতানুগতিক
বিদায়ী অনুষ্ঠানের বদলে যেভাবে ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল,তা আজও আমার চোখে জল এনে দেয়৷শিক্ষক জীবনে বেশ কিছু ছাত্রকে হাতে-পিঠে
গড়েছিলাম,তার মধ্যে ইলিয়াস একজন৷মা-মরা ছেলেটাকে দেখেই আমার
মনে হয়েছিল,ছেলেটার মধ্যে সম্ভাবনা আছে,শুধু একটু ঘষামাজা দরকার৷ব্যস,লেগে পড়েছিলাম
কাজে৷ক্লাসে পেছনের সারি থেকে একদম সামনের সারিতে এসে শেষ করেছিল ইলিয়াস৷বেরোবার
আগে অশ্রুসজল চোখে প্রণাম করে বলেছিল,"কোনদিন সময় পেলে
বাড়ি যাবেন স্যার৷"আজ অবসর গ্রহণের ছ বছর পর হঠাৎ ইলিয়াসের ফোন,"স্যার,খুব অসুস্থ৷একবারটি বাড়িতে আসবেন৷খুব
দরকার৷"ওকে দেখতে কেমন যেন টান অনুভব করলাম৷আর সেই কারনেই মামুদপুরে আসা৷
এসে অবশ্য একটু আশ্চর্যই
হতে হল৷ইলিয়াসকে নাকি কেউ চেনে না!কোথায় বাড়ি তাও জানে না!গ্রামের দিকে তো এরকম
হয়না!এখানে তো সবাই সবাইকে আত্মীয় ভাবে৷যাই হোক,খানিকটা খুঁজতে খুঁজতে গ্রামের শেষ
প্রান্তে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর দেখে এগিয়ে গেলাম সেদিকে৷দেখলাম এক বুড়ো বসে আছে
জুবুথুবু হয়ে৷ওকেই জিজ্ঞেস করলাম,"আচ্ছা,ইলিয়াসদের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?"
বুড়োটা কেমন যেন চমকে
উঠলো—"ইলিয়াস!কোন ইলিয়াসের কথা বলতাছেন কত্তা?"
—"যে
দৌলতাবাদে পড়তো৷মাঝবয়সী ছেলে৷বাপের নাম যদ্দূর মনে পড়ছে হারুন৷"
বুড়ো এক দৃষ্টিতে
কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো—"ও তো এ গেরামে থাকে না কত্তা!সেই কবে ওদের গেরাম থেকে খেদিয়ে দিছে!তারপর
থেকে আর পাত্তা নাই!"
—"সে
কি!শুনলাম ও নাকি খুব অসুস্থ৷"
আবার কিছুক্ষণ চেয়ে বুড়ো
বলল—"অসুস্থ কে নয় কত্তা?এ জগতে পুরো সতেজ লোক কেউ
নাই৷সবাই কোন না কোন ভাবে ভুগছে৷কেউ শরীলে,কেউ মনে৷এই আমাকেই
দেহেন না..."
বুড়োর সাথে আর কথা বাড়ানো
নিরর্থক মনে করে এগিয়ে গেলাম সামনের জঙ্গলটার দিকে৷দেখি যদি কোন খোঁজ পাই৷খুব ঘন
বন মনে হয়নি যদিও,তবে ঢুকতে ঢুকতে বেশ খানিকটা ঢুকে খেয়াল করলাম যতখানি ভেবেছিলাম,তার থেকে বেশি গভীর এই জঙ্গলটা৷নগরায়ণের থাবা থেকে যে কিভাবে এটা বেঁচে
আছে,তা ভাবতে ভাবতেই এগোচ্ছিলাম৷একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য
করছিলাম,ঘন বন হলেও পায়ে চলার রাস্তা কিন্তু আছে৷কেউ যেন রোজ
এই পথেই যায়৷এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে৷ফিরতে হবে৷আরেকটু এগোতেই একটা ত্রিপলের চালা
নজরে পড়লো৷শতচ্ছিন্ন চালাঘরের আশেপাশের গাছপালা কাটা৷ঘরের বাসিন্দারাই বোধহয়
বসবাসের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা করেছে৷একটু ইতস্তত করে একটু নিচু হয়ে ঢুকে পড়লাম
চালাঘরটায়৷ভেতরটা স্বাভাবিকভাবেই অন্ধকার৷চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় কে যেন বলে
উঠল,"আপনি এসেছেন স্যার!"
এত বছর পরেও গলা চিনতে
ভুল হলনা৷
—"তুমি কোথায়
ইলিয়াস?তোমায় তো দেখতে পাচ্ছি না৷"
—"আপনার
সামনেই আছি স্যার,অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছেন না৷"
—"তা হবে
হয়তো৷তা তোমার কী অসুখ করেছে?আর তুমি আমার ফোন নম্বর পেলে
কীভাবে?"
—"আপনি ঐ
স্কুলের নামকরা স্যার৷আপনার নম্বর জোগাড় করা কষ্টকর কী?"
—"হুম,আর অসুখ!"
—"অসুখ কী আর
একটা স্যার৷আপনি তো সবই জানতেন,বাপটা ছিল পাঁড় মাতাল৷হেন
কুকাজ নেই যা করতো না৷তাই গ্রামের লোকেরা আমাদের গ্রামছাড়া করলো৷পড়াশোনাটা আর
চালানো গেল না৷ কাজের খোঁজে লেগে পড়লাম৷কিন্তু কাজ কী আর গাছে ফলে?কখনও লেদ কারখানায়,কখনো ছাপাখানায়,কখনো মুটেগিরি,কখনো বা স্টেশনে কুলির কাজ করতে
লাগলাম৷শরীর আর কত সইবে!ব্যস,ধরলো নানা অসুখে৷বাপটাও
মরলো৷ডাক্তার যে দেখাবো,পয়সা কই!"
—"সে কি!তুমি
আমার সাথে যোগাযোগ করলে না কেন?"
—"আর কত ঋণী
করবেন স্যার আমায়!গোটা স্কুলজীবনটা তো আপনার দয়াতেই কাটালাম৷স্কুল থেকে বেরিয়ে
আসার পরও আর কীভাবে আপনাকে বিব্রত করি স্যার!"
মনে পড়লো,ওর পেছনে আমি
যথাসাধ্য নিয়ে লেগে পড়েছিলাম৷মাইনের অর্ধেকটাই ওর পেছনে খরচ করতাম৷কিন্তু ও যে আজও
সেসব মনে রেখেছে দেখে অবাক হলাম৷বললাম,
—"তোমাকে যত
দেখি অবাক হই ইলিয়াস৷এই পরিবেশে থেকেও এত ভালো ধারণা তোমার মধ্যে কীভাবে গড়ে ওঠে
ভাবলে বিস্মিত হই৷তো আজ কেন আমার কথা মনে পড়লো?"
—"ঐ ঋণ
স্যার!ভাবলাম,এত ঋণ নিয়ে মরেও শান্তি নেই৷তাই আপনাকে কষ্ট
করে ডাকা৷"
—"কিসব
উল্টোপাল্টা কথা বলছো৷তোমার চিকিৎসা দরকার৷কোথায় তুমি?চলো
আমার সাথে৷"
—''আমি এখন অন্তিম
শয্যায় স্যার৷আমার অনুরোধটুকু রাখুন দয়া করে৷ঐ কোণায় একটা বাক্স রাখা আছে৷ওটা খুলে
দেখুন ওর মধ্যে একটা ছোট পুঁটুলিতে শ' তিনেক টাকা পড়ে
আছে৷ওটাই আমার শেষ সম্বল স্যার৷আপনি ওটা নিন স্যার৷''
—"কি বলছো কি
তুমি?ওই টাকা দিয়ে তো প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু করাতে পারতে৷তা
না..."
—"আমার আর
চিকিৎসা হবে না স্যার৷আপনি ওটা নিন৷আমার ঋণ একটু শোধ হোক৷নইলে যে আমি শান্তি পাবো
না৷"
—"পাগলামি করো
না৷চলো তো আমার সাথে৷"বলেই আমি শব্দ লক্ষ্য করে এগোলাম৷হাত বাড়াতেই হাতে একটা
ঠান্ডা স্রোত খেলে গেল৷তারপর আমার আর কিছু মনে নেই৷
চোখ খুলতেই দেখি আমি একটা
দাওয়ায় শুয়ে আছি৷আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে সেই বুড়োটা৷আমাকে চোখ মেলতে দেখে বুড়োটা
বলল—
"আমার পুরো কথাখান
না শুইন্যাই তো চলি গেলেন৷ইলিয়াস কি আর আছে গো!সে যে কবেই চলি গ্যাছে৷তা আপনে ওই
কবরস্থানে ক্যানে গেছিলেন?ওখানে আর কেউ যায় না৷আমি না গেলে আপনারে ওখানেই পড়ি থাকতি হত৷"
আস্তে আস্তে উঠে বসে
বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে কাটাতে কি যেন মনে হতেই পাশে রাখা ঝোলাটায় হাত ভরলাম৷হাতে
বেরিয়ে এল তিনটে ময়লা একশো টাকার নোট৷ইলিয়াস সত্যিই ওর ঋণ শোধ করে গেছে,ওর সাধ্যমতো!
No comments:
Post a Comment