অণুগল্প -
আনন্দপুরীর কালীবাড়ি
-“ তখন ঠিক কোন সাল হবে!! এই ধর আশির দশকের গোঁড়ার দিকে। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমি এক প্রাইভেট ফার্মে কর্মরত। রেলের এই চাকরির পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ফল তখনও বেরোয়নি। অগত্যা ভরসা বলতে এই চাকরিটা, বসে থাকিনি কখনো। সকাল ৭ টা নাগাদ বেড়িয়ে, ট্রেনে করে শিয়ালদাহ, সেখান থেকে ডালহৌসি, তারপর ফিরতে ফিরতে সেই রাত, একটু কিছু মুখে দিয়ে ঘুম, পরদিন সকালে আবার সেই ঘোড়দৌড়। তো এই ছিল আমার ডেইলি রুটিন, ওই যাকে বলে গিয়ে struggling period.”
-“ তার মানে প্রেম-টেম বিশেষ......,” বলাতে উনি আমার দিকে এমন কটমট করে চাইলেন যে আর ওই ব্যাপারে কথা বলতে সাহস হল না।
নিজের মননেই তিনি বলে চললেন, “ এখনকার ব্যারাকপুরের সাথে সেই সময়ের ফারাক কিন্তু বিস্তর। এ ব্যারাকপুর এখন অনেক বর্ণাঢ্য, অলংকৃত, রূপান্তরিত এবং সর্বোপরি আধুনিক। তালবাগান, মানে যেখানে আমাদের বাড়ি, এখনতো ফ্ল্যাটের মালাগাথায় এক জনবহুল এলাকা কিন্তু সে সময়ে আমাদের বাড়ির সামনে থেকে ষ্টেশন অবদি ধূ-ধূ করতো বিশাল খেলার মাঠ আর রাত নামলেই মানুষের বদলে জায়গা দখল নিত অগুনতি জ্বলন্ত চোখ,” গলার স্বরে কথাও যেন অস্বাভাবিকতা।
একটু ভেবে খানিক মাথা চুলকে বললাম, “শেয়াল কি?”
-“বিলক্ষণ,” একটু মুচকি হাসলেন, তারপর বললেন, “আর সারারাত ধরে চলতো তাদের কোরাস কীর্তন। তো একদিন হল কি, অফিস থেকে ছাড়া পেতে হয়ে গেল দেরি। তুই তো জানিসই যে এই প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর কি হাল। ছুটির কোন সময়খন নেই। দেখবি, একবার যদি কোন ভাবে দেরি হয়ে যায় তখন সময়ের সাথে সাথে তার মাত্রা যেন আরও চড়তে থাকে। দেরির সাথে আরেকটু দেরি, তার সাথে আরেকটু এবং সব শেষে তার রূপ অতি ভয়ংকর। দৌড়াতে দৌড়াতে, প্রায় ঘেমে নিয়ে নৈহাটি লোকাল মিস করে হাফাতে হাফাতে যে ট্রেন ধরলাম তার নাম রানাঘাট। লাস্ট ট্রেন, স্বভাবতই প্রায় ফাঁকা কিন্তু ব্যারাকপুর যখন পৌঁছালো তখন রাত বারোটা। রাস্তাঘাট শুনশান, দোকানিরা অনেকক্ষণ আগেই ঝাঁপ বন্ধ করে যে যার নিজ সংসারে সুখে আবদ্ধ; এক গোছা চুল দাড়ি ময়লা জামাকাপড়ে রিক্ত পাগলও শান্তি নিদ্রায়, হয়তো স্বপ্ন দেখছে কোন এক রাজপ্রাসাদের আর কিছু দূরে নিষ্প্রাণ রিক্সার ভিড় যারা মালিকের চাবুক থেকে নিস্তার পেয়েছে মাত্র। হাঁটা ছাড়া গতি নেই তাই অগত্যা হাঁটতে শুরু করলাম। আসে পাশের আওয়াজ বলতে পা মাড়িয়ে চলা কাঁকড়, দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর চোর ওসচলের মাঝে বিভেদ না বোঝা এক পাল কুকুর। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের স্তূপ, রাস্তার টিমটিমে আলোয় প্রায় দেখা যায়না কিছুই।
তুই তো জানিসই যে সেন্ট্রাল রোড ধরে গেলে কতটা ঘুরতে হয় তাই সময় বাঁচাতে ঠিক করলাম আনন্দপুরী কালীবাড়ির মাঠটা ক্রস করে যাবো। লোকমুখে শুনেছিলাম যে মাঠটা ভালো নয়, তারা অতি প্রাকৃতিক কিছু দেখেছে কিন্তু ওই সব গাঁজাখুরি তে বিশ্বাস আমার কোন কালেই ছিল না। তখন রক্ত গরম, সেই দেমাক, ‘সবকটা কে দেখে নেব’ ভাব। এতো আলো তখন ছিল না, শুধু মন্দিরের সামনে ওই হ্যাজাক জাতীয় কিছু আর বাকিটা কে অন্ধ বলাই চলে। তো নিজের মনে হাঁটছি, পা চলছে একটু জোরেই, হঠাৎ মনে হল আমার পিছনে কেউ যেন হাঁটছে, আমায় ফলো করছে। আমি যত জোরে হাঁটছি, সেও তাই। আস্তে হাঁটলেও ফল সেই এক। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দেখলাম, চোখ বলছে কেউ নেই কিন্তু মন তা মানতে নারাজ। কোথাও একটা অস্বস্তি, বুঝতে পারছি যে কেউ রয়েছে আমার সাথে কিন্তু তাকে দেখতে বা ধরতে পারছি না। এর সাথেই হঠাৎ করেই যোগ হল নূপুরের আওয়াজ। এতো রাতে!! উঁহু, এতো রাতে কেই বা নাচ শিখবে!! এবং তার রেশ যথাক্রমে বেড়ে চললো। আমার গায়ের প্রতিটা রোমকূপ খাড়া, গলা শুকিয়ে কাঠ, পা শক্ত হয়ে আর নড়তে চাইছে না যেন। এরকম ভাবে কতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম জানিনা। তারপরেই, এ কি!! এ কি দেখছি আমি!! মন্দিরের সামনে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা। এতক্ষণ খেয়াল করিনি কিন্তু আগে থাকলে নিশ্চয় আমার চোখে পরত। সে উঠেছে, এক পা দু পা, চলতে শুরু করেছে কিন্তু তার পা নেই। বিশ্বাস কর, সে শূন্যে ভর করে এগিয়ে আসছে আর এগিয়ে আসছে ঠিক আমারই দিকে।
-“ কি!! কি বলছ কি তুমি!! তুমি সত্যিই দেখেছো!! বিশ্বাস হচ্ছে না।”
-“ বিশ্বাস করাটা আপেক্ষিক। আমি নিজেও এর উত্তর পাইনি কোনদিন; আমিও মানতে চাই যে এটা ভুল। ভুলে যেতে চাই এই ঘটনা কিন্তু সব কিছু কি এতো সহজেই ভোলা যায়!! কাউকে ভুলে যেতে চাইলে সে যেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে। তুই তো জানিস যে আমি কোনকালেই ড্রিঙ্ক করিনা এমনকি সিগারেটও নয়, তাই সেদিন পুরো সচল ছিলাম বলেই আমার বিশ্বাস।
-“ হুম, বুঝলাম, তারপর?”
-“ তখন নড়বার ক্ষমতা নেই আমার, পাগুলো যেন অসাড়, মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বোধয় টাল খেয়ে পড়ে যাবো মাটিতে। তিনি এলেন, খুব কাছে, আমার থেকে মাত্র তিন চার হাত দূরে কিন্তু মুখ থেকে ঘোমটা সরলো না তাই চিনতে পারিনি।সে যেন কাছে এসে আমায় হাত নেড়ে ডাকছে, “আয়, কাছে আয়... আরো কাছে...আয়...কিরে আয়,” ঠিক যেমন এসেছিলেন নিঃশব্দে আবার নিঃশব্দেই মিলিয়ে গেলেন যেন। আমি তখন ঠকঠক করে কাঁপছি, পৈতা জাপটে ধরে নাগাড়ে গায়ত্রী মন্ত্র আউরে চলেছি, হঠাৎ কোথা থেকে শক্তি পেলাম জানিনা, লাগালাম প্রাণপণে দৌড়, সোজা সেই সেন্ট্রাল রোড আর সেই মহিলার অট্টহাসি আজও কানে বাজে; ব্যাস, আর কিছু মনে নেই।”
-“বাড়ি ফিরলে কি করে?”
-“ জানিনা। যখন জ্ঞান হল দেখলাম নিজের ঘরে শুয়ে। কি করে এলাম, কে দিয়ে গেল, কিচ্ছু মনে নেই। পড়ে শুনেছিলাম আমি নিজেই নাকি হেঁটে ফিরি কিন্তু সেটা আমার মনে পড়ে না। পুরোটা ব্ল্যাঙ্ক।”
সমীর কাকুর কোথা শুনে কেমন যেন থম মেরে গেলাম। এতো শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ মিথ্যে বানিয়ে বলবেন বলে তো মনে হয়না। এও কি সম্ভব!! হয়তো এ জগতে এখনও এমন অনেক কিছু ঘটে যা আমাদের পরিসরের ঊর্দ্ধে। শুনেছিলাম, সিপাই বিদ্রোহের সময়ে অনেক ভারতীয়দের হত্যা করে এই মাঠের নিচে পুতে দেওয়া হয়েছিল, এ কি তারই প্রত্যয়!! হয়তো তাই।
হঠাৎ খেয়াল হল যে বাড়ি ফিরতে হবে আমায়, আর সেই রাস্তা গেছে ওই মাঠের মধ্যে দিয়েই।।
No comments:
Post a Comment