অণুগল্প -
সাইকেল
ট্রেন থেকে নেমেই কপালে ভাঁজ পড়ল
গৌরের।পুরো স্টেশন চত্তর খাঁ খাঁ করছে; শুধু প্লাটফর্মের এক ধারে কয়েক জন
ফুটপাতিয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে লাশের মতন প’ড়ে আছে।প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে এল গৌর, একটাও অটো নেই স্ট্যান্ডে।আর থাকবেই বা
কেন—জানুয়ারির এই কনকনে মধ্যরাতে লেপের গরম
ঘুম ছেড়ে কি আর কেউ বাইরে টহলদারি হাঁকায়! এলাকার লোকেদের তো আর পাগলা কুকুরে
কামড়ায়নি।
“আমারই হয়েছে যত পোড়া কপাল নইলে কি আর এমন
ছিটেল বস জোটে! সময়-অসময় নেই ওনার মাথার ছিটপোকাগুলো হা-ডু-ডু খেলবে আর তার ঠেলা
সামলাতে হবে এই শর্মা’কে...” গজগজ করতে করতেই বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল গৌর। শুনশান রাস্তা তায়
শীতকাল,
চারপাশে প্রেতপুরীর
নিস্তব্ধতা;
গৌরের গা’টা ছমছম ক’রতে লাগল__সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।পকেট থেকে
মোবাইলটা বের করে দেখল পৌনে একটা বাজে।কিছু দূর এগিয়েই তার মনে হল কে যেন তাকে
পিছন থেকে ডাকছে! ক্রমে শব্দটা স্পষ্ট হল—“ দাদা ও দাদা...একবার এদিকে শুনবেন—”
থমকে দাঁড়ালো গৌর, তার বুকে তখন হাতুড়ি পেটার অবস্থা।সে
কোনক্রমে ফিরে তাকাল—সহসা রাস্তার ধারের ঝোপের অন্ধকার থেকে চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল এক
ছায়ামুর্তি।
“বলছি, দাদা কি বাজারের দিকেই যাচ্ছেন?”
শুকনো গলায় গৌর জবাব দিল—“ তা যাচ্ছি, কিন্তু আপনি কে মশাই?”
“অধমের নাম ভজন তালুকদার।ভজা মাছওলা বলেই
সবাই চেনে।ওই বাজারের সমুখেই আমার বাড়ি।শালার বাড়ি থেকে ফিরছিলাম, তা এক হতচ্ছাড়া ট্যাক্সি মারল জোর ধাক্কা; সাইকেল শুদ্ধু উলটে পড়ে অজ্ঞান হয়ে
গেলাম।হুশ যখন ফিরল তখন রাস্তা শুনশান__গায়ে মাথায় বড্ড চোট লেগেছে, সাইকেলটা তুলে নিয়ে যে বাড়ি যাব সে
ক্ষমতা নেই আবার ফেলে রেখেও তো যেতে পারছি না! ফোন’টাও গেছে ভেঙে—কাউকে যে খবর দেব সে উপায়ও নেই।তাই সেই থেকে এখানেই ব’সে আছি; রাস্তায় কাউকে দেখতে পেলে একটু সাহায্য
চাইব ব’লে।তাই বলছি দাদা যদি দয়া ক’রে আমার সাইকেলটা আমার বাড়ি পৌঁছে দেন তো
বড্ড উপকার হয়!”
একটুখন ভেবে গৌর এগিয়ে গিয়ে সাইকেলটা তুলে
দেখল—ঠিক’ই আছে, চালিয়ে বাজার অব্ধি যাওয়াই যায়।ওখান থেকে
ওর বাড়ি তো পাড়ার ভিতর দিয়ে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা।সাইকেলের মালিককে অবিশ্যি
চাপিয়ে নিয়ে যেতে হবে; তা হোক, এতটা রাস্তা একলা হাঁটার চেয়ে একটু কষ্ট ক’রে সাইকেলে দোকা যাওয়া ঢের ভালো।
মনে মনে এই সব হিসেব কষে সদয় মুখে গৌর বলল—“ তা বেশ তো, আপনি ক্যেরিয়রে উঠে বসুন আমি বাড়ি অব্ধি
দিয়ে আসছি।”
অতঃপর দুজনে সাইকেলে
চেপে রওনা দিল গন্তব্যের দিকে।
#
পরেরদিন সকালবেলা—
চা’টা খেয়েই বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে
পড়ল গৌর।একবার ভজনবাবুর কুশল শুধিয়ে আসা উচিৎ আর সাথে যদি একখান সাইজের মাছ একটু
কম-জমে ম্যানেজ করতে পারা যায়; ভদ্রলোকের এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নিশ্চই থাকবে—নিজের মনেই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গত রাতের
বাড়িটার সামনে এসে হাজির হতেই একটা কানাঘুষো শুনে গৌরের পিলেটা শুকিয়ে যেন আমসি
হয়ে গেল।গতকাল সন্ধে নাগাদ স্টেশন থেকে ফিরতি পথে একটা গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছে
ভজন তালুকদার।ময়না তদন্দের পর সবেমাত্র মর্গ থেকে তার বডি বাড়িতে আনা হয়েছে অথচ
আশ্চর্যের বিষয় অকুস্থল থেকে উদ্ধার ক’রে ভজনবাবুর সাইকেলটা কে যেন কাল রাতেই
তার
বাড়ির উঠোনে রেখে
গেছে।
ফ্যাঁকাসে মুখ নিয়ে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে
কোনমতে একঝলক উঁকি দিল গৌর। ভজা মাছওলার লাশ বাঁধা খাটুলির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কাল
রাতে ওর চালিয়ে আনা সেই মুর্তিমান সাইকেলটা।।
দারুণ। একটা মজার চলে বয়ে যাওয়া গল্পটির পরিণতি এমন ভৌতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া অবশ্যই লেখিকার কৃতিত্ব।
ReplyDelete