Monday, January 14, 2019

অঙ্কন মুখোপাধ্যায়



অণুগল্প –  
ঋণশোধ

সুরেশবাবু ভাড়া মেটাতে গিয়ে দেখলেন মানিব্যাগ রাখবার পকেটটা ফাঁকা। মানিব্যাগটা আনতেই ভুলে গেছেন বোধহয় । এখন ঠিক মনে পড়ছে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তাড়াহুড়োর মধ্যে মানিব্যাগটা নেওয়াই হয়নি। সুরেশবাবু পড়লেন সমস্যয়। মানিব্যাগ ভুলেছেন বলে তো আর ট্যাক্সিটাকে আটকে রাখা যায় না ,আবার ভাড়া না মেটালেও নয়।এদিকে সুরেশবাবু একজন মহাসজ্জন ব্যক্তি । কারো কাছে একপয়সা কোনদিন ধার করেছেন বলে শোনা যায় নি।বরং মানুষের বিপদে আপদে তাঁর দরাজ স্বভাবের জন্য তাঁর খ্যাতি আছে ।সেই সুরেশ বাবু কিনা আজ এমন একটা সমস্যায় পড়লেন। ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন এটাওটা ভাবছেন,এমন সময় অন্ধকারের ভিতর থেকে  একজন অচেনা লোক সুরেশবাবুকে পিছন থেকে এসে  ডাকলেন,- 
-সুরেশবাবু ভাড়াটা আমি দিয়েদিচ্ছি।
সুরেশবাবু আশ্চর্য হয়ে ফিরে তাকালেন।
-আপনি? আপনি  আমার ভাড়া মেটাবেন ? কিন্তু কেন? আর আমি আপনার টাকা নেবোই বা কেন... 
সুরেশবাবুর কথা শেষ করতে না দিয়ে লোকটি বলল,- একে ঝড়জল,তার উপর রাত অনেক হলো বেচারা ড্রাইভারটাকে আর আটকে রাখবেন না । এই বলে সুরেশবাবু আরো কিছু বলার আগেই লোকটা সুরেশবাবুর ভাড়া হিসেবে পাঁচশো টাকা মিটিয়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল।
ট্যাক্সির ব্যাকলাইটের লাল চোখ দুটো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সুরেশবাবু বললেন,- আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না... কিন্তু ঘন অন্ধকারে লোকটা আছে না নেই সেটাই সুরেশবাবু ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না। সুরেশবাবু কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে লোকটাকে ডাকতে লাগলেন ,- মশাই গেলেন কই? বলি ও মশাই ।কে আপনি ? ও মশাই কোথায় গেলেন? তারপরেই আকাশ ফাটিয়ে একটা বাজ পড়ল কিছুদূরে।আর সেই বাজের আলোয় সুরেশবাবু যা দেখলেন তাতে তার রক্ত যেন বরফে পরিণত হল।সুরেশবাবু দেখলেন দূরে ল্যামপোস্টের নীচে গোলগাল চেহারার বেঁটে মধ্যবয়সী একজন লোক গোলগোল চোখে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে,আর বিদ্যুতের আলোয় চকচক করছে লোকটার চুল ওঠা টাকা মাথাটা। সুরেশবাবুর মনেপড়ে কয়েক মাস আগের একটা ঘটনা ।
কয়েক মাস আগে কম্পানির কাজে সুরেশবাবু গিয়েছিলেন দাঁতনহাটি গ্ৰামে।যেদিন গ্ৰামে পৌঁছালো সেদিন ছিল শনিবার ,সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ।আর চলছে আজকের মতোই অঝোরে বৃষ্টি শ্মশানের পাশদিয়ে গ্ৰামে ঢোকার রাস্তা । সুরেশবাবুর হঠাৎ চোখে পড়ল কারা যেন এই দূর্যোগের রাতে ওই শ্মশানের ছোট্ট চালাঘরটায় ঝগড়া করছে।ঠিক মানুষের গলার মতো।সুরেশবাবু তার পুরানো মটরবাইকটা থামিয়ে কৌতহল বলে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। একটা মরদেহকে ঘিরে গুটিকয়েক গ্ৰামের লোক বচসা করছে একজন কঙ্কালসার ব্রাহ্মণের সাথে ।
বলেছিতো পাঁচশো টাকার একটা পয়সা কমে আমি অনন্তের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করবো না । - বামুনটি বলল।
কেন কথা বাড়াচ্ছেন ঠাকুর মশাই ? দেখছেন তো গরিব মানুষ । টাকা পয়সা তেমন নেই। কাজটা করে দিন না।তার উপর এই জলঝড় - পাশথেকে বলল একটা চ্যাংড়া ছেলে।
তুই থাম হতভাগা।- ধমক দেয় বামুনটি।
মরদেহটির কাছে বসে একজন ছোট ছেলে এই সব দরকষাকষি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মৃতদেহের ছেলে এই ভাবে সুরেশবাবু একটু সহানুভূতি জাগল।
পাঁচশো টাকা তো? আমি দিয়ে দিচ্ছি । - সুরেশবাবুর কথা সবাই পিছন ঘুরে তাকালো। 
আপনি
আমার পরিচয় পরে হবে , টাকাটা নিন। আর তাড়াতাড়ি ওঁনার কাজকর্ম করে শেষকৃত্য  শেষ করুন ।
নগদ পাঁচশো টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বামুনটি মরদেহের স্বর্গে যাওয়ার ব্যবস্থা করল।চালাঘরের বাইরে তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সঙ্গে ব্যাঙের একটানা ডাক কানে আসছে চারিদিকের ঝোঁপ ঝোঁপ জঙ্গল থেকে ।কুলকুল করে বৃষ্টিজমা জল বয়ে পুকুরে পড়ার শব্দ আসছে চালাঘরের পিছন থেকে। বলো হরি হরি বোল - বলে মরদেহটি চিতায় তোলা হল। চিতায় তোলবার আগে সুরেশবাবু ভালোকরে দেখলেন মরদেহটি। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারার মধ্যবয়সী লোক।ঘি মাখা দেহটা তার ছেলের হাতে ধরা পাটকাঠির আগুনে চকচক করছে ।সবচেয়ে বেশি চকচক করছে লোকটার টাকা মাথাটা। 
আর একটা বাজে সুরেশবাবুর ঘোর ভাঙলো।ল্যাম্পপোস্টের নীচটা ফাঁকা।সুরেশবাবুর ডাটা শিরশির করে উঠল। হাওয়া বইছে জোড়ে। আর সেই হাওয়ার ভেসে কে যেন বলছে ,- ঋণশোধ করে গেলাম সুরেশবাবু... ঋণশোধ ...

No comments:

Post a Comment