অণুগল্প-
ভূত ও শাকচুন্নি
তাদের দুজনের যে
একসঙ্গে মৃত্যু হবে এটা বোধয় ভবেশবাবু বা তার স্ত্রী সৌদামিনী নিজেরাও জানতেন না | আগে থেকে
জানতে পারলে, ভবেশবাবু
অন্তত যমদূতকে বলেকয়ে মৃত্যুর তারিখটা কয়েকদিন আগে পরে করে নিতেন | সৌদামিনী
তাকে আজীবন জ্বালিয়েছে |
জীবনের
অর্ধেকের বেশি সময় ঝগড়া করে কাটিয়েছে | মরেও কি শান্তি নেই ?
ভবেশবাবু যে বোকা ,গাধা , কোনো কাজের
নয় ,অপদার্থ ,কুঁড়ে , এসব তিনি
সৌদামিনীর
সাথে
বিয়ে
না হলে হয়তো কোনোদিনও জানতে পারতেন কিনা সন্দেহ | লোকে বলে স্বামী
স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি সাত জন্মের | সৌদামিনীকে সাতজন্ম ধরে জীবনসঙ্গিনী
পাবার দুঃস্বপ্নে ভবেশবাবুর মাঝে মাঝে রাতের ঘুম চলে যেত |
এ হেন
স্ত্রীর হাত ধরে একসঙ্গে যমপুরীতে যাওয়া যে কি ভয়ঙ্কর ,ভেবে ভেবে
ভবেশবাবু
মরেও শান্তি পাচ্ছিলেন না | ঠাকুমা বলতেন যমরাজ
নাকি পাপীদের গরম তেলের কড়ায় ভাজে | জীবদ্দশায় ভবেশবাবুর জীবন, সৌদামিনী
ভাজাভাজা করে ছেড়েছে |
এখন
তাই যমরাজ তাকে নিশ্চয় অন্য শাস্তি দেবেন, এটুকু ভরসা যমরাজের ওপর ভবেশবাবুর আছে
|
তার
অশরীরী আত্মা অস্থিরভাবে এদিক ওদিক
পায়চারি করতে লাগলো |
তিনি নিশ্চিত জানতেন
যে , সৌদামিনীর
কোনো বিষয়েই তর সয় না |
সে
নিশ্চয় ভবেশবাবুর জন্য অপেক্ষা না করেই আগে আগে যমপুরীতে চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে
আগেভাগে পাশের লোকটির সাথে ঝগড়া করে কিছু একটা পেতে ভবেশবাবুর জন্য জায়গা রাখবে | সৌদামিনীর , ভবেশবাবুর
অক্ষমতার ওপর অগাধ আস্থা | সৌদামিনী জায়গা না রাখলে ভবেশবাবু হয়তো ভিড়
বাসের
মতোই এককোণে বোকার মতো গুটিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকবে |
যমপুরীতে
কতক্ষন শুনানি চলবে তার কি ঠিক আছে | অতক্ষণ কি দাঁড়ানো যায় ? দুজনেরই আবার
হাঁটুতে বাত |
ভবেশবাবু তার
স্ত্রীকে বিলক্ষণ চিনেছিলেন | হঠাৎই আকাশে কালো মেঘ জমলো | বজ্র বিদ্যুৎ
সহ প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা শুরু হলো |ভবেশবাবু অনুমান করলেন সৌদামিনী নিশ্চিত পৌছেঁ
গেছে |যমপুরীর গোটা
রাস্তাটা ভবেশবাবু একা একাই মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে পাড়ি দিয়ে দিলেন |
যমপুরীতে কি ভিড় |বনগাঁ
লোকালেও এতো ভিড় হয়না বোধয় | পা রাখার জায়গা নেই | পাপীতে
পাপীতে গিজগিজ করছে |
একের
পর এক
পাপীকে চিত্রগুপ্তের সামনে হাজির করা হচ্ছে , শুনানি হচ্ছে
,আর তাদের
পাশের একটা ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে | প্রত্যেক মামলার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় বরাদ্দ |নাহলে তো সামলানো যাবে না | ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা কলকাতার
পাবলিকরা হয়তো একটু ফুরসৎ পেলেই ,মিটিং, মিছিল, ধর্ণা ,অনশন, ঘেরাও এ বসে
যাবে |
চিত্রগুপ্ত
কোনো ঝুঁকিই নিচ্ছেন না |
ফটাফট
সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন |
নাহ, এতক্ষন বেশ
শান্তিতেই কাটলো ভবেশবাবুর | সৌদামিনীকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না | মেয়েদের মনে
হয় আলাদা লাইন, আলাদা
চেম্বার |
তিনি
হাঁফ ছাড়লেন |
অল্পসময়েই ভবেশবাবুর
পালা এলো |
তিনি
সামনে আসতেই চিত্রগুপ্ত তাকে চিনতে পারলেন | ভবেশবাবু অবাক , চিত্রগুপ্ত তার নামও জানেন | তাকে দেখে
চিত্রগুপ্তর চোখেও জল এলো |
বেচারা
সংসারজীবনেই নরকযন্ত্রণা ভোগ করে এসেছে গো | তিনি একটা
কাগজে খসখস করে শাস্তি লিখে খামে ভরে যমদূতের হাতে দিলেন | যমদূত তাকে
আর একটা ঘরে নিয়ে গেলো |
" ওমা ,তুমি কখন এলে
?"
সৌদামিনীর
গলা |বড় চেনা সেই
সুর|
ভবেশবাবু
আঁতকে উঠলেন |
আবার
?
কিন্তু বরাবরের মতো
মনের ভাব মনে লুকিয়ে তিনি জবাব দিলেন ," এই এলাম "
সেই চেনা প্রশ্ন আবার
,"এতক্ষন কোথায়
মরেছিলে শুনি "
বিরক্ত ভবেশবাবু
এবারও সত্যি কথাই বললেন ,"
যমের
দুয়ারে "
সৌদামিনী একগাল হেসে
বললেন ,"ওমা তোমায়
কিরকম দেখতে হয়ে গেছে গো, একেবারে
ভূতেদের মতো "
ভবেশবাবু আর নিজেকে
সামলাতে পারলেন না |
সারাজীবনের
সব রাগ উগরে দিয়ে নাঁকি গলায় বলে উঠলেন ,”তুমি কিন্তু একই রকম আছো | আগেও
শাকচুন্নি ছিলে এখনো তাই আছো |"
No comments:
Post a Comment