Monday, January 14, 2019

পিনাকী বসু



অণুগল্প-
ভূত ও শাকচুন্নি

তাদের দুজনের যে একসঙ্গে মৃত্যু হবে এটা বোধয় ভবেশবাবু বা তার স্ত্রী সৌদামিনী নিজেরাও জানতেন না | আগে থেকে জানতে পারলে, ভবেশবাবু অন্তত যমদূতকে বলেকয়ে মৃত্যুর তারিখটা কয়েকদিন আগে  পরে করে নিতেন | সৌদামিনী তাকে আজীবন জ্বালিয়েছে | জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় ঝগড়া করে কাটিয়েছে মরেও কি শান্তি নেই ?
ভবেশবাবু যে বোকা ,গাধা , কোনো কাজের নয় ,অপদার্থ ,কুঁড়ে , এসব তিনি সৌদামিনীর  সাথে   বিয়ে না হলে হয়তো কোনোদিনও জানতে পারতেন কিনা সন্দেহ | লোকে বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নাকি সাত জন্মের | সৌদামিনীকে সাতজন্ম ধরে জীবনসঙ্গিনী পাবার দুঃস্বপ্নে ভবেশবাবুর মাঝে মাঝে রাতের ঘুম চলে যেত |
 এ হেন স্ত্রীর হাত ধরে একসঙ্গে যমপুরীতে যাওয়া যে কি ভয়ঙ্কর ,ভেবে ভেবে ভবেশবাবু  মরেও শান্তি পাচ্ছিলেন না | ঠাকুমা বলতেন যমরাজ নাকি পাপীদের গরম তেলের কড়ায় ভাজে | জীবদ্দশায় ভবেশবাবুর জীবন, সৌদামিনী ভাজাভাজা করে ছেড়েছে | এখন তাই যমরাজ তাকে নিশ্চয় অন্য শাস্তি দেবেন, এটুকু ভরসা যমরাজের ওপর ভবেশবাবুর আছে তার অশরীরী আত্মা অস্থিরভাবে এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলো
তিনি নিশ্চিত জানতেন যে , সৌদামিনীর কোনো বিষয়েই তর সয় না | সে নিশ্চয় ভবেশবাবুর জন্য অপেক্ষা না করেই আগে আগে যমপুরীতে চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে আগেভাগে  পাশের লোকটির সাথে ঝগড়া করে কিছু একটা পেতে ভবেশবাবুর  জন্য জায়গা রাখবে | সৌদামিনীর  , ভবেশবাবুর  অক্ষমতার ওপর অগাধ আস্থা | সৌদামিনী জায়গা না রাখলে ভবেশবাবু হয়তো ভিড় বাসের  মতোই  এককোণে বোকার মতো গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে | যমপুরীতে কতক্ষন শুনানি চলবে তার কি ঠিক আছে | অতক্ষণ কি দাঁড়ানো যায় দুজনেরই আবার হাঁটুতে বাত |
ভবেশবাবু তার স্ত্রীকে বিলক্ষণ চিনেছিলেন | হঠাৎই আকাশে কালো মেঘ জমলো | বজ্র বিদ্যুৎ সহ প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা শুরু হলো |ভবেশবাবু অনুমান করলেন সৌদামিনী নিশ্চিত পৌছেঁ গেছে  |যমপুরীর গোটা রাস্তাটা ভবেশবাবু একা একাই  মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে পাড়ি দিয়ে দিলেন |
যমপুরীতে কি ভিড় |বনগাঁ লোকালেও এতো ভিড় হয়না বোধয় | পা রাখার জায়গা নেই | পাপীতে পাপীতে গিজগিজ করছে | একের পর এক  পাপীকে চিত্রগুপ্তের সামনে  হাজির করা হচ্ছে , শুনানি হচ্ছে ,আর তাদের পাশের একটা ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে | প্রত্যেক মামলার  জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় বরাদ্দ |নাহলে তো সামলানো যাবে না | ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা কলকাতার পাবলিকরা হয়তো একটু ফুরসৎ পেলেই ,মিটিং, মিছিল, ধর্ণা ,অনশন, ঘেরাও এ বসে যাবে | চিত্রগুপ্ত কোনো ঝুঁকিই নিচ্ছেন না | ফটাফট সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন |
নাহ, এতক্ষন বেশ শান্তিতেই কাটলো ভবেশবাবুর | সৌদামিনীকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না | মেয়েদের মনে হয় আলাদা লাইন, আলাদা চেম্বার | তিনি হাঁফ  ছাড়লেন |
অল্পসময়েই ভবেশবাবুর পালা এলো | তিনি সামনে আসতেই চিত্রগুপ্ত তাকে চিনতে  পারলেন | ভবেশবাবু অবাক , চিত্রগুপ্ত  তার  নামও জানেন | তাকে দেখে চিত্রগুপ্তর চোখেও জল এলো | বেচারা সংসারজীবনেই নরকযন্ত্রণা ভোগ করে এসেছে  গো | তিনি একটা কাগজে খসখস করে শাস্তি লিখে খামে ভরে যমদূতের হাতে দিলেন | যমদূত তাকে আর একটা ঘরে নিয়ে গেলো |
" ওমা ,তুমি কখন এলে ?" সৌদামিনীর গলা |বড় চেনা সেই  সুর| ভবেশবাবু আঁতকে উঠলেন | আবার ?
কিন্তু বরাবরের মতো মনের ভাব মনে লুকিয়ে তিনি জবাব দিলেন ," এই এলাম "
সেই চেনা প্রশ্ন আবার ,"এতক্ষন কোথায় মরেছিলে শুনি "
বিরক্ত ভবেশবাবু এবারও সত্যি কথাই বললেন ," যমের দুয়ারে "
সৌদামিনী একগাল হেসে বললেন ,"ওমা তোমায় কিরকম দেখতে হয়ে গেছে গো, একেবারে ভূতেদের মতো "
ভবেশবাবু আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না | সারাজীবনের সব রাগ উগরে দিয়ে নাঁকি গলায় বলে উঠলেন ,”তুমি কিন্তু একই রকম আছো | আগেও শাকচুন্নি ছিলে এখনো তাই আছো |"

No comments:

Post a Comment