Monday, February 18, 2019

নন্দিতা মিশ্র



গল্প -
প্রতিশ্রুতি

    পুব দিকের জানালা দিয়ে ভোরের রক্তিম আভা এসে পড়ল সুনন্দার বিছানায়। এক চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে সে অবাক হয়ে তাকাল সেদিকে। জানালার মোটা পর্দা ভেদ করেও রবি মামা তার উপস্থিতি যেন আজ পৌঁছে দিচ্ছেন সুনন্দার কাছে।
   না, ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে গেলেও আজ যেন বিরক্তি এল না তার মনে। মনে মনে করল প্রতিশ্রুতি সে সূর্যের কাছে....
" তোমার ন্যায় দীপ্তিতে জ্বলে উঠবোই আমি।"
জানাল সূর্য্যিমামা..."তবে কিন্তু আমার ন্যায় দগ্ধ হতে হবে, তবেই পাবে এ দীপ্তি। পারবে তো দগ্ধ হতে?"
..."পারবই"....প্রতিশ্রুতিতে অনড় সে।
   ছাদের বাগানে ফুটে ওঠা গন্ধরাজে এসে বসেছে আজ এক জোড়া প্রজাপতি। আহাহা কিবা শোভা তার। দেখে দ্রুত পায়ে কাছে গেল সুনন্দা। এ ফুল থেকে ও ফুল উড়ে উড়ে ফুলের পরাগ মেখে তাদের যে আনন্দ তা দু চোখ ভরে উপলব্ধি করলো সে। আপাত দূরত্ব বাঁচিয়ে বললো তাদের..."আমিও আমার রঙে সাজাবো এ ভুবন। এ প্রতিশ্রুতি আমার।'
একটা প্রজাপতি সুনন্দার মাথার উপর পাক খেতে খেতে বললো..."তোমার জোড় কোথায়? একা একাই রাঙাবে নাকি?"
প্রভাত সূর্যের রক্তিম আভায় শ্যমলিমা সুনন্দার গালেও লেগেছিল রঙের পরশ, প্রজাপতি র কথায় সে লালিমা দশ গুন বেড়ে গেল যে সপ্তদশীর। সলজ্জ উত্তর দিল সে...
...'না! একা কেন? আমারও তো জোড় হবে! দিদা বলেছেন, পৃথিবীর কোথাও কোন এক কোণে আমার জন্যও উঠেছে কেউ গড়ে। সময় হলে দেখা দেবে ঠিক।"
...'তাই নাকি! তবে মিলে যাও জোড়ে, রাঙাও ভুবন"...জানালো অন্যজনা।
"ধ্যাৎ"...বলে এক ছুটে ছাদ থেকে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো সুনন্দা।
   দাঁড়ালো আয়নার সামনে। লক্ষ্য করলো সে, যৌবন যেন বান ডেকেছে তার শরীরে। মুগ্ধ বিস্ময়ে নিজেকে নিজেই দেখলো বারবার, বারংবার। 
তার কাজ দেখে হেসে ফেলল আয়না, বললো..."কি ব্যাপার! আজ সকাল সকাল নিজের প্রতি এত প্রেম, প্রেমে পড়লে নাকি?"
..."না, পড়িনি এখনো, কিন্তু পড়বোই।"
..."তাই! জানা আছে তার জন্যে দ্বিতীয় ব্যক্তির হয় প্রয়োজন"...আয়নার সহাস্য উত্তর।
...'জানি তো! তবু বলি তোমায়, প্রেমে আমি পড়বই।'
...'কিন্তু, নিজেকে সামলে রাখতে পারবে তো?'
..."তোমার মত স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব তুলে ধরবো নিজের, চিরদিন...চিরকাল।"...এ প্রতিশ্রুতি আমার।
...'স্বচ্ছতা দেয় না সব সুখ, মেকিতাই পাওয়া যায় বেশ, ভেবে দ্যাখো।'
...'হয়ে গিয়েছে ভাবা। স্বচ্ছতা সুখ না দিলেও শান্তি তো দেবে। ওই নিয়েই কাটিয়ে দেব তবে এ জীবন।'
   আরো একবার আয়নায় নিজেকে আপদ মস্তক দেখে তোয়ালেটা হাতে নিয়ে চলে গেল সে স্নানঘরে।
   স্নানঘরে ঢুকে নিজেকে উন্মুক্ত করে দাঁড়ালো ঝর্ণার নীচে। আসতে আসতে কলের নব ঘুরাতে থাকল। আর ঝর্ণা হতে জল বিন্দু... বিন্দু থেকে ধারায় পরিণত হয়ে সিক্ত করলো তাকে।
  সিক্ত হলো তার মন, আবেগে দ্রবীভূত হয়ে প্রতিটি বারিবিন্দুকে স্পর্শ করার ইচ্ছায় বাড়ালো হাত, মেলে দিল নিজেকে।
বারিবিন্দু গুলি তার চুল ছুঁয়ে, শরীরের প্রতিটি কোণা ছুঁয়ে যেতে যেতে বলে গেল..."আবেগে সিক্ত করতে পারবে আমার মত করে?"
...'পারবই আমি। আমার আবেগ দিয়ে সিক্ত করবো তাকে, এ প্রতিশ্রুতি আমার।'...চোখ বন্ধ করে জলের পরশে সিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল সুনন্দা।
..."নিঃস্বার্থ হতে হবে তবে"....
...' নিঃস্বার্থে হব আবেগময়'...বলে ওঠে সে।
স্নান সেরে দ্রুত খাবার খেয়ে বের হচ্ছিল কলেজে। পথ আগলাল শেরু....সুনন্দার পোষ্য। পায়ের কাছে কুঁই কুঁই করতে করতে পথ আগলাল সে।
..."প্রাপ্তির আনন্দে কর্তব্য ভুলিস না কখনো!"...যেন পথ আগলে পায়ের কাছে মুখ ঘষে ঘষে বলে গেল সে। সুনন্দা পরম আদরের শেরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল... "বিশ্বাস নেই তোর মোর প্রতি, প্রাপ্তি শুধু প্রাপ্তিই, সে পারবে না কোনদিন কর্তব্য ভোলাতে...কথা রইল।"
...এক নিশ্চিত আশ্বাস নিয়ে ঘরে চলে গেল শেরু আর সুনন্দা পা বাড়ালো কলেজ অভিমুখে।
কলেজের পেছনের দরজা দিয়ে সোজা ক্লাসে, কবিতা ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছেন...বাংলা ক্লাস।
...'ম্যাডাম, আসবো?"
...কটা বাজে?
...সরি ম্যাম, একটু দেরি হয়ে গেল।
...এভাবে দেরি করে আসলে পড়া বুঝতে পারবে? আর দেরিতে এসে কেউ আমার ক্লাসে ডিসটার্ব করুক এটা আমার খুব অপছন্দ।
..."আর হবে না, ম্যাডাম। ঠিক সময় মত আসবো কাল থেকে,কথা দিচ্ছি।"
..."এসো, তাড়াতাড়ি নিজের জায়গায় বসো।"
   দ্রুততার সাথে ক্লাসরুমে প্রবেশ করলো সুনন্দা। ম্যাডাম পড়াতে শুরু করলেন..
"মথুরাবাসী রাজা কংসের অত্যাচারে ক্লান্ত। তারা ভগবানকে ডেকে বললেন, ' হে নারায়ণ, আর কতদিন এ যাতনা সইতে হবে। আমাদের রক্ষা করো, প্রভু'
এমন সময় দৈববানী হলো...'শীঘ্রই পাবে মুক্তি'।
   দ্বারাকার মায়া কাটিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ফিরে গেলেন মথুরাই। রাজকার্যে মনোনিবেশ করলেন তিনি। একদিন বড়াই উপস্থিত তার কাছে...
"প্রভু, আপনার অদর্শনে শ্রীমতী রাধিকা চলশক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। আপনি একবার তাঁর সাথে দেখা করুন। "
" প্র্গলভা নারীদের আমি পছন্দ করি না।"...শ্রীকৃষ্ণ এই বার্তা দিয়ে বড়াই কে পাঠিয়ে দিলেন।"
.....শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বুঝিয়ে চলেছেন ম্যাডাম। আর সুনন্দার মনে একরাশ প্ৰশ্ন, তবে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিশ্রুতি গুলো কি মিথ্যে ছিল? কীভাবে রাধার কাছে করা প্রতিশ্রুতি গুলো গৌণ হয়ে গেল আজ।
  প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই ঘন্টা পরে গেল। ম্যাডাম চলে গেলেন।
জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখলো একজোড়া শালিক একে অন্যের কাছে প্রমান দিয়ে চলেছে তাদের ভালোবাসার। গুটি গুটি পায়ে গেল সে সেখানে। শালিক পাখিদুটি কিচিমিচি করে বলে উঠলো...
"জোড়া শালিখ দেখেও তোমার মুখ কেন ভার?"
..."না না, সে কিছু নয়। ভাবছি অন্য কথা!"
..."কি সে কথা, বলা যায় না নাকি?"
..."না, তা নয়, ভাবছি, শ্রীকৃষ্ণ কেন রাধাকে এত কষ্ট দিলেন?"
..."ও! সে তো অন্য কথা। কর্তব্যের চেয়ে বড়ো কিছু নেই। প্রেম সে তো অন্তরের ধন। আর তা ছিল ও তাদের। কিন্তু সেখানে ভালোবাসার চেয়েও বড় ছিল আর্তদের হাহাকার।"
...'ও, তাই বুঝি ভাঙা যায় প্রতিশ্রুতি?? এতই ঠুনকো তা!"
..."এখনো ছোটো তুমি, একথার উত্তর পাবে একদিন, পাবেই।"
..."হয়তো! তবু কর্তব্যের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতি রাখারই করবো চেষ্টা। এ আমার প্রতিশ্রুতি।"... ধীর পায়ে ফিরে এল কমনরুমে।
  পাশেই চোদ্দ নম্বর রুম। খুব হাসির আওয়াজ আসছে সেখান থেকে। কাজরি এসে কমন রুম থেকে টেনে নিয়ে গেল সুনন্দাকে।
সুমন দা, বরেন দা, দীপেন দা সহ সব উঁচু ক্লাসের দাদারা সেখানে আড্ডা বাড়ছে। ঘরময় ধোঁয়ায় ধোঁয়াময়।
ঘরে ঢুকেই ফিরে আসতে চাইল সুনন্দা। এক ঝটকায় কাজরির হাত ছাড়িয়ে চৌকাঠের বাইরে পা দিয়েছে সে। এক পা তখনো ঘরের মধ্যেই।
...'তুমি পছন্দ করো না জানি, তাই আজ থেকে সিগারেটের সাথে আমার আড়ি? এ প্রতিশ্রুতি আমার।'
চৌকাঠের বাইরের পা টা ঢুকলো ঘরে। আর গলার স্বর লক্ষ্য করে গেল দৃষ্টি। বরেন দা হাত থেকে সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে কচলে ভেঙে পিষে দিতে দিতে বলে উঠলো আবার...
...'প্রথম যেদিন তুমি দুই কাঁধে দুটি বেণী ঝুলিয়ে এসেছিলে কলেজে, ও দুটি হরিণ চোখে ছিল হালকা কাজল...সেদিনই, সেদিন থেকেই এ মন ও চোখে বাধা পড়ে গেছে। বলো তুমি, কি করলে ও মনে জায়গা পাবো আজীবন। করবো আমি। কথা দিলাম।"
   অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সুনন্দা। ও জানে কিছুদিন থেকে ছায়ার মত অনুসরণ করে চলেছে বরেন দা। কাজরিকে দিয়ে বলেও পাঠিয়েছে মনের কথা। কিন্তু ভাবেনি সুনন্দা, এভাবে আজই...সবার সামনে এভাবে ভালোবাসার প্রকাশ করবে বরেন দা।
    চুপ করে বেড়িয়ে আসছিল সে।
..."উত্তর দিলে না? তবে কি মৌনতায় সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিতে পারি?"..
মৃদু সরে জানালো সে,..." প্রতিশ্রুতি রাখার জন্য করতে হয় কিন্তু, ভাঙার জন্য নয়। যে কোন পরিস্থিতিতে সেটা রাখাই ধর্ম।" .....হাততালি তে ফেটে পড়লো চোদ্দ নম্বর রুম। বরেন কে কোলে তুলে নিল সুমন আর দীপেন মিলে। আর সুনন্দা দ্রুত পায়ে কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল।
  পুবের খোলা জানালা...স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে ঘর। খাট থেকে নেমে মৃদু পায়ে জানালায় দাঁড়ালো সুনন্দা।
জ্যোৎস্না মাখা রাত বললো তার কানে কানে...."কি সখী, জোড় জুটে গেল তবে আজই!" লজ্জায় লাল হয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো সে, ...'হ্যাঁ।'
"এবার আমার কাছে কি প্রতিশ্রুতি তোমার?".... চন্দ্রমামার স্নিগ্ধ জিজ্ঞাসা।
"তোমার মত রব স্নিগ্ধ। ব্যস আর কিছু নয়।"
   রাতের তারা, নক্ষত্র, রাত জাগা পাখি একসাথে গেয়ে উঠলো গান,এক ভালোবাসার প্রতিশ্রুতির জানালো সম্মান।

No comments:

Post a Comment