গল্প-
সমাদৃতা
"সুবর্ণ!"- প্রচন্ড ভিড় ট্রেনে হঠাৎ নিজের নাম
শুনে চমকে উঠলাম। যতোটা সম্ভব ঘাড় বেঁকিয়ে চোখ দুটো উপর-নীচ-ডান-বাম সর্বাভিমুখে চালনা করলাম; কিন্তু চেনা কারোর মুখাবয়ব নজরে পড়লো না।
আমি সুবর্ণ, সুবর্ণ কৃষ্ণ মল্লিক। ছোট্ট একটা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করছি
প্রায় পনেরো বছর হলো। সামান্য কটা টাকার
হাতছানি আমাকে নিত্যদিন নব্বই কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ হাসিমুখে অতিক্রম করতে বাধ্য করায়। নিয়মিত সহযাত্রী'দের সাথে বকবক করতে করতে দিব্যি
কখন যে গন্তব্যে পৌঁছে যাই, টেরই পাই না। সেই বকবকানি'তে হরেক রকম আলোচনা স্থান পায়; সমাজ-সভ্যতা-রাজনীতি-সংস্কৃতি-নারীসুরক্ষা-আন্তর্জাতিক
খবরের বিশ্লেষণ- কী নেই তাতে! ভিড়ের
মধ্যে সবাই আমার এক নাগাড়ে আওড়ে যাওয়া বুলি গুলো হাঁ করে শোনে, গুপী গাইনের গানের মতো সম্মোহিত হয়
বুঝি! কখনো আবার ঝালমুড়ির
ঠোঙাটা জানালা দিয়ে হাওয়ার বিপরীতে ফেলে সিগারেট ধরাই। কোনো কোনো সহযাত্রী আমার দামী 'গোল্ড ফ্লেক'টার দিকে উৎসুক ভাবে চেয়ে থাকে; আমি কিন্তু কোনো সিগারেট অফার করি না, উল্টে একরাশ বিষাক্ত ধোঁয়া ছেড়ে
দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে ওদের ক্যান্সারের
সঙ্গী করি।
আজকে
ট্রেনটা অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশীই ভিড়। আজ আবার মকর
সংক্রান্তি; পুণ্যি সঞ্চয়ের ব্যর্থ আশায় চোর-সাধু সবাই গঙ্গাস্নান করতে যাচ্ছে। আমার
সামনে টুকু অন্ধকার; একজন ভদ্রলোক অভদ্র ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিশ্রী পিছন দিকটা বারবার আমার দিকে
এগিয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। যতোবার ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি, উনি ততোই নাছোড়বান্দা রূপ
ধারণ করছেন।
গন্তব্যের প্রায় অর্দ্ধেক পথ
এসেছি। ততক্ষণে ট্রেন অনেকটা হালকা। মুখের সামনে ভিড় টাও আর নেই। আমি জানালার দিকে
তাকিয়ে সিগারেট ধরিয়ে একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ চাহনি নিয়ে গুনগুন করছি। মনের
মধ্যে তখন "তুমি আসবে বলে..." গানের লিরিক্সের হিজিবিজি অনুকম্প।
"তুই সুবর্ণ না!"-সামনের সিটে উপবিষ্ট এক ভদ্রমহিলা সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে
দিলো। ভ্রু কুঁচকে মনে মনে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছি আমি। বলা নেই, কওয়া নেই একেবারে 'তুই'! 'তুমি' বললে তবুও না হয় সয়ে নিতাম।
আর যাই হোক, এখনো যথেষ্ট যৌবন
আমার মধ্যে প্রচ্ছন্ন। আমার ধারণা, আমার অন্যমনস্কতার সুযোগ
নিয়ে এখনও হাজার হাজার যুবতী আমায় নিয়ে কল্পনার জগতে বিচরণ করে। চোখ কটমট করে আপাদমস্তক ভদ্রমহিলা-কে
নিরীক্ষণ করলাম। চুলগুলো বেশ ছোটো ছোটো করে কাটা, পরনে চুড়িদার,
জিন্স। চোখে রোদচশমা, কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, কপালে গাঢ়
লালরঙা সিঁদুর। আমি আমার চশমার মাইনাস ফাইভ পয়েন্ট
ফাইভের কাচ দুটো মুছে আবার পরলাম। চশমার উপর দিয়ে ওনার দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ
করে জিজ্ঞেস করলাম- "আপনি চেনেন আমায়"? উত্তর এলো- "আরে আমি
সমাদৃতা রে। তুই আমায় সমু বলে ডাকতিস। চিনতে পেরেছিস এবার?" অনেকক্ষণ ভাবলাম-
"সমাদৃতা কে? শুধু সমাদৃতা'য় হয় না, আবার সমু!" হঠাৎ ওনার মুখাবয়বটা পরিচিত কারোর মুখমণ্ডলের সদৃশ মনে হলো।
অনেক পুরোনো স্মৃতি হৃদমাঝার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলো। তবুও মুখে
অপরিচিতের অবহেলিত ভাবটা বজায় রেখে বললাম-
"ম্যাডাম,
আপনার বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি আপনাকে চিনি
না।" কান্নার সুরে তখন সমু আধো আধো ভাষায় বলে উঠলো- "জানি, তুই চিনেও না চেনার ভান করছিস। আসলে আমি যে ভুল
করেছি- তার তো কোনো ক্ষমা হয় না, বল!" এবার আমি রাগ কমিয়ে শান্তভাবে বললাম- "বছর কুড়ি আগের সময়টা
ছিলো জীবনের একটা অন্ধকার
অধ্যায়। সেসব কথা ভেবে আর কী লাভ!" সমু আমার চোখের
দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, আমি হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই স্থিরভাবে ওর দিকে তাকাতে পারছি না।
একসময়ের ভালোবাসা সমু আজ বিবাহিতা,
ও আজ পরনারী। ওর সৌন্দর্য্য নিংড়ে নেওয়ার অধিকার আমার আর নেই। কারোর
মুখে কোনো কথা নেই। ট্রেনের চাকা আর রেললাইনের কর্কশ বিবাদের সাঁইসাঁই
আওয়াজ, হকারদের একনাগাড়ে হাঁক পাড়া- সমস্ত নীরবতা গ্রাস করেছে। স্তব্ধতার
চাদর সরিয়ে সমু আমার হাতদুটো ধরে বললো- "আবার সবকিছু আগের মতো হতে পারে
না?" আমি এক ঝটকায় হাত টেনে নিয়ে বললাম- "কী পাগলামি করছেন আপনি! আমরা
দুজনেই বিবাহিত। পৃথিবীতে আর ক'দিনই বা আছি! এসব
অবাস্তব কথা বলে বাস্তবকে দয়া করে ছোটো করবেন না।"
খানিক পরেই গন্তব্যে ট্রেন এসে হাজির। কাঁধে ব্যাগ
ঝুলিয়ে চুলটা একটু ঠিকঠাক করে তড়িঘড়ি নেমে গেলাম। যাবার সময় বললাম- "আসি, হয়তো আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না। আমাকে
আর কোনোভাবেই খোঁজার চেষ্টা করবেন না"। দুচোখ ভর্তি অশ্রুর প্লাবন নিয়ে
সমু আমায় বিদায় দিলো, বললো- "আয়"।
স্টেশন থেকে স্কুল পায়ে হেঁটে মিনিট সাতেকের রাস্তা। মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তা, মাঝে মাঝে মোরাম বিছানো।
রাস্তার দুইধারে সারি-সারি
মেহগিনি আর বট গাছের সমাগম। গাছ পেরিয়ে উন্মুক্ত চাষজমি; সোনালি হলুদ সরিষা ফুলের মেলা বসেছে সেখানে।
অন্যদিন প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ যে কী হলো!
সাত মিনিটের পথ চলতে যেন সাত যুগ সময় অপচয় হচ্ছে, পথ কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।
স্কুলে গিয়ে টানা দুটো ক্লাস নিয়ে
স্টাফ রুমে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে একটু বিরাম দেওয়ার চেষ্টায় মগ্ন হলাম।
শরীরটা টানটান করে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে টেবিলে হাতের উপরে মাথা রেখে চোখের
পাতা বুঁজতে মন চাইলো। কিন্তু কিছুতেই চোখের পাতা এক করা গেলো না। চোখের
সামনে বারবার ছবির মতো ভেসে উঠলো আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে ঘটে যাওয়া
জীবনের কিছু সুখস্মৃতি, যদিও ওটাকে আমি 'দুর্ঘটনা' বলেই মনে করি।
তখন আমি কলেজে, দ্বিতীয় বর্ষ।
পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছি। বেশ লম্বা গড়ন, মুখে চাপদাঁড়ি, মাথায় বেশ সুন্দর করে টেরিকাটা একগোছা
চুলের বাহার- যাকে এক কথায় বলে মেয়েদের 'ক্রাশ' হয়ে ওঠার মতো সুপাত্র। পড়াশোনাতেও খারাপ ছিলাম না। তাই যৌবনে নতুন
নতুন নারী চরিত্রের আনাগোনা একটা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তৃতীয়
বর্ষে উঠে সমাদৃতা'র সঙ্গে আলাপ। বরাবরই ওর চুল ছোটো করে ছাঁটা। নিত্যনতুন রঙবেরঙের চুড়িদার, ফ্রক, শালোয়ারে ওকে আমার পছন্দ
হতো না। শুধু যেদিন শাড়ি পরে কলেজ আসতো, সেদিন সারাটা বেলা আমি শুধুই ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইতাম। রূপ যেন ফেটে পড়ছে, সৌন্দর্য্য বুঝি নিজের
সীমালঙ্ঘন করে ছাপিয়ে যাচ্ছে!
আমরা একসাথে কলেজঘাটে বসে কতোই না গালগল্প করতাম।
ঝালমুড়ি পছন্দ ছিলো না ওর। পছন্দের আইসক্রিম খেত আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে। আমি কিন্তু মোটেই
ঈর্ষান্বিত হতাম না, হ্যাংলার মতো ওর আইসক্রিমের দিকেও তাকাতাম না। আমি ঝালমুড়ির ঠোঙার ভিতরেই নিমজ্জিত
করতাম নিজেকে। সেইদিনটা আজও মনে আছে;
বাইশে এপ্রিল,
বুধবার ছিলো খুব সম্ভবত। আমাকে নাকি ও খুব পছন্দ করতো।
ঠিক আমাকে নয়, আমার কথা বলার ধরণ, প্রতিবাদী চাহনি, ব্যক্তিত্ব- এ সবই নাকি ওর পছন্দের ছিলো। তাই নিজেকে আর সামলাতে না
পেরে সেদিন ক্লাসের মাঝে বলেই ফেললো- "সুবর্ণ, আমি তোকে ভালোবাসি।" আমার তো চক্ষু চড়কগাছ; এ দেখি মেঘ না চাইতেই জল। ততক্ষণাৎ নিজেকে জাহির করার
জন্য কিছু বলিনি ওকে। তবে আমার আচারে-ব্যবহারে ও বুঝতে পেরেছিলো আমি ওর
প্রতি ভীষণ দুর্বল।
কাহিনীতে ট্র্যাজেডি এসেছিলো কলেজ পাশ করার পরে। আমি
তখন বেকার, ছোটোখাটো দু-চারটে টিউশনি করে হাতখরচটা কোনোমতে চালাতাম। সমু বারবার আমায়
বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে। এদিকে চাকরি না পেয়ে, নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে
কোনোমতেই বিয়ে করবো না- এরকম একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল আমার মনে। এভাবে
কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন পোস্টম্যান একটা বিয়ের চিঠি বাড়ি বয়ে দিয়ে
গেল। চিঠিটা খুলতেই বাস্তব আর কল্পনা জগতের ফারাক বুঝতে দেরী হলো না।
চিঠিটা সমু'র বিয়ের। আমারই কলেজের সহপাঠী অম্লানের সাথে ওর বিবাহ নির্ধারিত। অম্লান একটা বড়ো প্রাইভেট
কোম্পানি'তে সদ্য চাকরি পেয়েছে,
বেশ মোটা মাইনে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল কিনা মনে নেই, তবে বারবার অদৃশ্য শূন্যতা
আমাকে গ্রাস করত। বিয়ের দুদিন আগে সমু আমার সাথে শেষবারের জন্য দেখা করতে চেয়েছিল। না, আমি ফিরিয়ে দিইনি। দেখা
করেছিলাম। সেদিন ও সেই গোলাপি শাড়িটা
পরে এসেছিল,
আমার খুব প্রিয় ছিলো ওই শাড়িটা। আঁচল দিয়ে আমার চোখ
মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিল- "বিশ্বাস কর, তুই খুব ভালো। তবে আমার
পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।" শেষবারের
জন্য বলেছিলাম- "আর কটা দিন অপেক্ষা...!" মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে শেষবাক্যটা
চটপট শুনিয়েছিল- "আসি,
ভালো থাকিস।" তারপর আর কখনো সমু'র হদিশ পায়নি। অনেকবার চেষ্টা করেছি ও কেমন আছে
জানতে। পারিনি কোনোভাবেই। আজ প্রায় কুড়ি বছর পরে সমু'র দেখা পেলাম চলন্ত ট্রেনে।
হ্যাঁ, আমার সমু, আমার জীবনের একমাত্র
ভালোবাসা সমাদৃতা। তবে আজ সময় সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমি
আজ অন্য একজনের স্বামী, আমার সোনাই-এর বাবা। সমুও তেমন অন্য কারোর স্ত্রী, আমার কেউ নয়। আমার কাছে সমাদৃতা আর
পাঁচটা মেয়ের মতোই পরনারী।
"কী হে সুবর্ণ, বাড়ি যাবে না!"-
হেডস্যারের ডাকে ঘোর ভাঙলো। ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখি বিকাল পাঁচটা। দু’ঘণ্টা আগে স্কুল ছুটি হয়ে
গেছে। সাড়ে চারটের ট্রেনটা এতোক্ষণে পগার পাড়। অগত্যা শেষ ট্রেনের অপেক্ষা, সন্ধ্যে সাতটায় তার দেখা পাওয়া যাবে।
স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন ট্রেন এসে গেছে। চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে ট্রেনে
চাপলাম। আজ জানালার ধারে সিট পেয়েছি। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা
হাওয়া গায়ে এসে লাগছে, বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।
ব্যাগ থেকে হেডফোনটা বের করে কানে গুঁজলাম। "প্রেম
একবারই এসেছিল নীরবে..."
গানের ছন্দে বুকটা আবার শূন্যতায় হু হু করে উঠলো, কীসের একটা চাপা কষ্ট আমাকে এতোটা আবেগপ্রবণ করে
তুলছে বুঝতে পারলাম না। ক্ষতবিক্ষত মন নীরবে যেন বলছে শুধু- "আমি ভালো
আছি। এই তো বেশ আছি"।।
No comments:
Post a Comment