স্মৃতিচারণা—
'হারিয়ে যাওয়া পঞ্চমী গান'
সরস্বতী পুজো এলেই মনের মধ্যে উঁকি দেয় ফেলে আসা শিশুবেলা ৷ একথা
একেবারেই সত্যি যে, আজ
থেকে বছর পনেরো আগেও আমরা যেভাবে সরস্বতী পুজো করতাম, তার
এখন আমূল পরিবর্তন হয়েছে ৷ আমরা ছোটোবেলায় গ্রামে গ্রামে পঞ্চমী গান গেয়ে চাল পয়সা
ভিক্ষে করে পুজোর খরচ যোগাতাম ৷ এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে ৷ মা বাবা তাদের সন্তানের
ছোটো ছোটো পকেটে ভরে দিচ্ছেন টাকা৷ তারাই পুজোর সরঞ্জাম জোগাড় করে দিচ্ছেন ৷ এমনটা
আমরা ভাবতেই পারতাম না ৷ তবে আমাদের পকেটে টাকা না থাকলেও পুজো করার অদম্য জেদ
ছিলো ৷ মা বাবা পাড়ার কাকা কাকি, দাদু দিদারা আমাদের উৎসাহ দিতেন ৷ বড়দের এই উৎসাহ দানই ছিলো আমাদের বড়
শক্তি ৷ হরি জ্যেঠু সাদা পাতায় পঞ্চমী গান লিখে আমাদের হাতে দিয়ে বলতেন
"গানটা মুখস্থ করে নিও সবায়"৷ আমরা গান মুখস্থ করে পুজোর একমাস আগেই
বেরিয়ে পড়তাম এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পঞ্চমী গাইতে ৷
পঞ্চমী গান সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে
গাওয়া হয় ৷ এই গান সাধারণত প্রশ্নত্তোরমূলক ৷ একজন প্রশ্ন করেন আর বাকিরা উত্তর
দেন ৷ যে প্রশ্নকর্তা সে গৃহকর্তা রূপে প্রশ্ন করেন ৷ কোনও বাড়িতে উপস্থিত হলে
স্বাভাবিকভাবেই গৃহকর্তা প্রশ্ন করতে পারেন আসার কারণ কি? কোথা থেকে আসছো প্রভৃতি ৷ এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় না৷ সমস্ত প্রশ্নের
উত্তর গানের মধ্যেই নিহিত থাকে৷
পঞ্চমী গান—
প্রশ্ন— শুন শুন ওহে শিশুগণ ভিক্ষা
নিতে এলে কিসেরই কারণ ?
উত্তর— মাঘে শুক্ল পঞ্চমীর দিনে
সারদা পূজিব মোরা করেছি মনে ৷
প্রশ্ন— সারদা পূজিয়ে কি হবে,
সারদা পূজিয়ে মুক্ত হলেন কে কুথায় ?
উত্তর— তবে কেন লিখিয়াছেন ব্যাস
সরস্বতী পূজে মুক্ত হলেন কালিদাস ৷
প্রশ্ন— যে বিদ্যা শিখিবে সে পূজিবে
অন্য লোকে কেন ভাই তারে পূজিবে ?
উত্তর— বাগবাদিনী বিদ্যাদায়িনী সে
কারণে করি পূজা জগৎ জননী ৷
প্রশ্ন— বাগবাদিনী কারে বলে ভাই
বুঝাইয়া বলো আমরা বুঝতে পারি নাই ৷
উত্তর— বাগবাদিনী নামের অর্থ এই
কণ্ঠে বসে বাক্য বলে ত্রিজগতে সেই ৷
প্রশ্ন— তবে তারে সবাই পূজিবো কিবা
রূপ কিবা ভূষণ শ্রবণ করিব ?
উত্তর— শ্বেত বর্ণ হলেন জননী
হংসরূপেবীরূসূতাকমলনয়নী ৷
প্রশ্ন— পূজার বিষয় বলো না রে ভাই কি
দিয়ে পূজিবো মায়ের রাঙা দুই চরণ ৷
উত্তর— ধূপ দীপ করো আয়োজন গন্ধ দীপ
পুষ্প আদি ও গুরুচন্দন ৷
প্রশ্ন— পূজার পরে কি করিত হয়
বুঝাইয়া বলো আমরা বুঝতে পারি নাই ৷
উত্তর— পূজার পরে পুষ্পাঞ্জলি হয়
পরেতে প্রণাম করে পূজা সমাপন করি ৷
মূল গান শেষ হবার পর আরও এক কলি গাওয়া হয় গৃহকর্তার
উদ্দেশ্যে মূলত বিদায় নেওয়ার জন্য এবং আমাদের মনের ইচ্ছা কি ও আমরা কোথা থেকে
এসেছি সেটাও গৃহকর্তাকে জানানো হয়—
"বিদায় করুন বাবু মহাশয়, আমরা
অধিক শিশু কিবা দিব পরিচয়
ঢেঙ্গাশোলে আমাদের নিবাস পূজিব সারদা মাতা মনে অভিলাষ" ৷
এরপর সকলে মিলে গৃৃহকর্তাকে বলতে হতো "চাল পয়সা দিয়ে বিদায়
করো গো" ৷ গৃহকর্ত্রী তখন সার্মথ্য মতো চাল পয়সা এনে আমাদের ঝুলিতে ঢেলে
দিতেন ৷ বিদায় নিয়ে আমরা পাশের ঘরে যেতাম ৷ সেই ঘরেও একই রকমভাবে পঞ্চমী গাইতাম ৷ এভাবে
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পঞ্চমী গেয়ে চাল পয়সা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন সূর্যদেব
পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তো ৷ সারা রাস্তা ধূলোয় খেলতে খেলতে বাড়ি ফিরতাম ৷ এখনও সেই
ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে ৷
পঞ্চমী গান গেয়ে যা চাল সংগ্রহ করতাম তা বড়রা
বাজারে বিক্রি করে ঠাকুর ও পুজোর সরঞ্জাম কিনে আনতেন ৷ ছোটো মূর্তি সেজন্য
অনেকগুলো ইঁটের উপর দেবী মূর্তি বসানো হতো ৷ মা কাকিদের শাড়ি দিয়ে বানানো হতো
প্যান্ডেল ৷ পুজো হতো, পুষ্পাঞ্জলি হতো ৷ লক্ষ্য করতাম
পুষ্পাঞ্জলির সময় বড় দাদা দিদিরা একে অপরের দিকে ফুল ছোড়াছুড়ি করতো ৷ আর একটু বড়
হয়ে বুঝেছিলাম সরস্বতী পুজো বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে ৷
বাবা আমাদের পুজোমন্ডপের নাম দিয়েছিলেন 'ঢেঙ্গাশোল দুর্বল শিশুগোষ্ঠী' ৷ নাম শুনে
সকলেই হাসতো ৷ পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছিলো আমাদের পুজোমন্ডপের নাম ৷ এখন দুর্বল
শিশুগোষ্ঠী সবল হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের পুজো মন্ডপের নাম বদলায়নি ৷
ভীষণ মনে পড়ে সেই সব দিনগুলোর কথা ৷ এখন সময় বদলেছে
৷ ছোটো থেকে বড় আমরা সবাই ইন্টারনেটে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছি ৷ এখন আর ছোটো ছোটো
ছেলেমেয়েরা গ্রামে গ্রামে পঞ্চমী গাইতে যায় না৷ পুজোর ধরনটাও বদলে গেছে ৷ মন্ডপে
মন্ডপে নোংরা রাজনীতির ছড়াছড়ি, ডি.জে মাইক, শব্দদূষণ ৷ নানা প্রতিযোগিতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব ৷ যা অত্যন্ত
বেদনাদায়ক ৷
Awesome Vai.... R o koyek ta gan diye lekha ta arektu baro korte parte.... Ses korte ichcha korchhilo na...
ReplyDelete