Monday, February 18, 2019

সাগর মাহাত


স্মৃতিচারণা
'হারিয়ে যাওয়া পঞ্চমী গান'

সরস্বতী পুজো এলেই মনের মধ্যে উঁকি দেয় ফেলে আসা শিশুবেলা ৷ একথা একেবারেই সত্যি যে, আজ থেকে বছর পনেরো আগেও আমরা যেভাবে সরস্বতী পুজো করতাম, তার এখন আমূল পরিবর্তন হয়েছে ৷ আমরা ছোটোবেলায় গ্রামে গ্রামে পঞ্চমী গান গেয়ে চাল পয়সা ভিক্ষে করে পুজোর খরচ যোগাতাম ৷ এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে ৷ মা বাবা তাদের সন্তানের ছোটো ছোটো পকেটে ভরে দিচ্ছেন টাকা৷ তারাই পুজোর সরঞ্জাম জোগাড় করে দিচ্ছেন ৷ এমনটা আমরা ভাবতেই পারতাম না ৷ তবে আমাদের পকেটে টাকা না থাকলেও পুজো করার অদম্য জেদ ছিলো ৷ মা বাবা পাড়ার  কাকা কাকি, দাদু দিদারা আমাদের উৎসাহ দিতেন ৷ বড়দের এই উৎসাহ দানই ছিলো আমাদের বড় শক্তি ৷ হরি জ্যেঠু সাদা পাতায় পঞ্চমী গান লিখে আমাদের হাতে দিয়ে বলতেন "গানটা মুখস্থ করে নিও সবায়"৷ আমরা গান মুখস্থ করে পুজোর একমাস আগেই বেরিয়ে পড়তাম এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পঞ্চমী গাইতে ৷
             পঞ্চমী গান সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে গাওয়া হয় ৷ এই গান সাধারণত প্রশ্নত্তোরমূলক ৷ একজন প্রশ্ন করেন আর বাকিরা উত্তর দেন ৷ যে প্রশ্নকর্তা সে গৃহকর্তা রূপে প্রশ্ন করেন ৷ কোনও বাড়িতে উপস্থিত হলে স্বাভাবিকভাবেই গৃহকর্তা প্রশ্ন করতে পারেন আসার কারণ কি? কোথা থেকে আসছো প্রভৃতি ৷ এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় না৷ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর গানের মধ্যেই নিহিত থাকে৷
পঞ্চমী গান
প্রশ্নশুন শুন ওহে শিশুগণ ভিক্ষা নিতে এলে কিসেরই কারণ ?
উত্তরমাঘে শুক্ল পঞ্চমীর দিনে সারদা পূজিব মোরা করেছি মনে ৷
প্রশ্নসারদা পূজিয়ে কি হবে, সারদা পূজিয়ে মুক্ত হলেন কে কুথায় ?
উত্তরতবে কেন লিখিয়াছেন ব্যাস সরস্বতী পূজে মুক্ত হলেন কালিদাস ৷
প্রশ্নযে বিদ্যা শিখিবে সে পূজিবে অন্য লোকে কেন ভাই তারে পূজিবে ?
উত্তরবাগবাদিনী বিদ্যাদায়িনী সে কারণে করি পূজা জগৎ জননী ৷
প্রশ্নবাগবাদিনী কারে বলে ভাই বুঝাইয়া বলো আমরা বুঝতে পারি নাই ৷
উত্তরবাগবাদিনী নামের অর্থ এই কণ্ঠে বসে বাক্য বলে ত্রিজগতে সেই ৷
প্রশ্নতবে তারে সবাই পূজিবো কিবা রূপ কিবা ভূষণ শ্রবণ করিব ?
উত্তরশ্বেত বর্ণ হলেন জননী হংসরূপেবীরূসূতাকমলনয়নী ৷
প্রশ্নপূজার বিষয় বলো না রে ভাই কি দিয়ে পূজিবো মায়ের রাঙা দুই চরণ ৷
উত্তরধূপ দীপ করো আয়োজন গন্ধ দীপ পুষ্প আদি ও গুরুচন্দন ৷
প্রশ্নপূজার পরে কি করিত হয় বুঝাইয়া বলো আমরা বুঝতে পারি নাই ৷
উত্তরপূজার পরে পুষ্পাঞ্জলি হয় পরেতে প্রণাম করে পূজা সমাপন করি ৷
           মূল গান শেষ হবার পর আরও এক কলি গাওয়া হয় গৃহকর্তার উদ্দেশ্যে মূলত বিদায় নেওয়ার জন্য এবং আমাদের মনের ইচ্ছা কি ও আমরা কোথা থেকে এসেছি সেটাও গৃহকর্তাকে  জানানো হয়
     "বিদায় করুন বাবু মহাশয়, আমরা অধিক শিশু কিবা দিব পরিচয়
      ঢেঙ্গাশোলে আমাদের নিবাস পূজিব সারদা মাতা মনে অভিলাষ" ৷
এরপর সকলে মিলে গৃৃহকর্তাকে বলতে হতো "চাল পয়সা দিয়ে বিদায় করো গো" ৷ গৃহকর্ত্রী তখন সার্মথ্য মতো চাল পয়সা এনে আমাদের ঝুলিতে ঢেলে দিতেন ৷ বিদায় নিয়ে আমরা পাশের ঘরে যেতাম ৷ সেই ঘরেও একই রকমভাবে পঞ্চমী গাইতাম ৷ এভাবে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে পঞ্চমী গেয়ে চাল পয়সা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন সূর্যদেব পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তো ৷ সারা রাস্তা ধূলোয় খেলতে খেলতে বাড়ি ফিরতাম ৷ এখনও সেই ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে ৷
          পঞ্চমী গান গেয়ে যা চাল সংগ্রহ করতাম তা বড়রা বাজারে বিক্রি করে ঠাকুর ও পুজোর সরঞ্জাম কিনে আনতেন ৷ ছোটো মূর্তি সেজন্য অনেকগুলো ইঁটের উপর দেবী মূর্তি বসানো হতো ৷ মা কাকিদের শাড়ি দিয়ে বানানো হতো প্যান্ডেল ৷ পুজো হতো, পুষ্পাঞ্জলি হতো ৷ লক্ষ্য করতাম পুষ্পাঞ্জলির সময় বড় দাদা দিদিরা একে অপরের দিকে ফুল ছোড়াছুড়ি করতো ৷ আর একটু বড় হয়ে বুঝেছিলাম সরস্বতী পুজো বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে ৷
         বাবা আমাদের পুজোমন্ডপের নাম দিয়েছিলেন 'ঢেঙ্গাশোল দুর্বল শিশুগোষ্ঠী' ৷ নাম শুনে সকলেই হাসতো ৷ পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছিলো আমাদের পুজোমন্ডপের নাম ৷ এখন দুর্বল শিশুগোষ্ঠী সবল হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের পুজো মন্ডপের নাম বদলায়নি ৷
          ভীষণ মনে পড়ে সেই সব দিনগুলোর কথা ৷ এখন সময় বদলেছে ৷ ছোটো থেকে বড় আমরা সবাই ইন্টারনেটে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছি ৷ এখন আর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা গ্রামে গ্রামে পঞ্চমী গাইতে যায় না৷ পুজোর ধরনটাও বদলে গেছে ৷ মন্ডপে মন্ডপে নোংরা রাজনীতির ছড়াছড়ি, ডি.জে মাইক, শব্দদূষণ ৷ নানা প্রতিযোগিতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব ৷ যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ৷

1 comment:

  1. Awesome Vai.... R o koyek ta gan diye lekha ta arektu baro korte parte.... Ses korte ichcha korchhilo na...

    ReplyDelete