গল্প
–
বিবর্ণ তিয়াসা
" তিয়াসা দেখ , ঈশান কোণে মেঘ জমেছে আজ । চল না রে -আজ একটু বোসেদের বড় দিঘির পারে গিয়ে বসি । ", দেবেশ তিয়াসার হাত ধরে বলল । দেবেশ আর তিয়াসা -ওরা ছোটবেলার বন্ধু । দেবেশ তিয়াসার চেয়ে বছর তিনেকের বড় । দুজনেই থাকে উত্তর চব্বিশ পরগনার রাজারহাটে । ছেলেবেলা থেকেই হেসেখেলে , বেণু মাসিমার বাগানের কুলটা -আমটা চুরি করে খেয়ে একসাথে বেড়ে ওঠা ওদের । আর এই বেড়ে উঠতে উঠতে দুটো সবুজ মন কখন যেন বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে -হয়তো ওদেরই অজান্তে ।
দেবেশ আর তিয়াসা -দীঘির পারে এসে বসে ।
"আচ্ছা দেবেশ দা -তোর তো এ বছর মেডিকেল এর লাস্ট ইয়ার । তারপর তো তুই ডাক্তার , আমাকে তখন তুই ভুলে যাবি নারে । " , তিয়াসা বেশ অভিমানী সুরে দেবেশকে বলে ।
" দূর বোকা মেয়ে তুই আমার কে জানিস -আমার প্রাণ , তুই এইখানে আছিস রে । " , বুকের বাঁ দিকে হাত রেখে তিয়াসার বিনুনী -তে একটান দিয়ে দেবেশ বলল ।
" দূর বোকা মেয়ে তুই আমার কে জানিস -আমার প্রাণ , তুই এইখানে আছিস রে । " , বুকের বাঁ দিকে হাত রেখে তিয়াসার বিনুনী -তে একটান দিয়ে দেবেশ বলল ।
তিয়াসা কলেজে পরে । ইংরাজী অনার্স এর ছাত্রী -সেকেণ্ড ইয়ার । তিয়াসা সুন্দরী , বেশ ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ । দিঘির তীরে বাঁধা একটা নৌকায় বসে পা -দুটো ঝুলিয়ে জলে ডুবিয়ে তিয়াসা হঠাৎ বলল , " জানিস দেবেশদা বাড়িতে আমার সম্বন্ধ দেখছে । "
দেবেশের বুকে যেন এক অজানা যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠল । তবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেবেশ বলল , "তবে করে নে --বিয়ে । "
তিয়াসার দুচোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে ।
চিৎকার করে বলে , " দেবেশ দা -তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না রে । "
দেবেশ আজ প্রথম স্বীকার করে ও তিয়াসা কে ভালবাসে ।
দুই -বছর কেটে গেছে । দেবেশ এখন একটা নামি নার্সিংহোমের ডাক্তার । দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে দেবেশ ও তিয়াসার বিবাহ স্থির হয়েছে আগামী ৫ই ডিসেম্বর । বিবাহের ঠিক একমাস পূর্বে দেবেশ তিয়াসা কে বলে ,
" জানিস আজকাল খুব মাথা যন্ত্রণা করে , ঘুমাতে পারি না । "
তিয়াসা বলে , " দেবেশ দা , তুই কাজের প্রেসার একটু কমিয়ে দে না রে , শরীরের দিকে তোর একদম নজর নেই । "
দেবেশ তিয়াসার দুই হাত চেপে ধরে বলল , " তুই আমার বৌ হয়ে এলে খুব শাসন করবি নারে ?"
" করবই তো। " , তিয়াসার প্রতি উত্তর।
এর পর থেকে দেবেশের শরীর বেশ ভেঙে পড়তে থাকে । প্রায়ই অসয্য মাথা যন্ত্রণা , বুকের ভিতর থেকে কী একটা অস্বস্তি গুলিয়ে উঠতে থাকে । ভীষন বমি ভাব , মাঝে মাঝে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে ওর ।
বিবাহের নির্দিষ্ট দিনের ঠিক পাঁচদিন অবশিষ্ট । আবার সেই দীঘির পারে দেবেশ তিয়াসাকে ডাকে । আজ দেবেশ কেমন যেন এক অন্যরকম । নির্নিমেষ নয়নে তিয়াসার দিকে চেয়ে থাকে ও ।
"এমন করে কী দেখছিস দেবেশ -দা ? "
দেবেশ কেমন এক অচেনা ধরা গলায় ধীরে ধীরে বলল ," এ বিয়ে আমি করতে পারব না তিয়াসা " ।
তিয়াসা কী শুনল ? ঠিক শুনল তো ? এক মুহুর্ত সে নিশ্চুপ। এরপর অবাক বুকের পাঁজর দুমড়ে -মুচড়ে উঠে আসা যন্ত্রণা নিয়ে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় দেবেশের প্রতি , "কেন দেবেশ দা , কী বলছিস তুই ? "
বৃষ্টিধারা আজ তিয়াসার দুই চোখে । কিন্তু গোধুলির আলো -আঁধারির খেলায় দেবেশের চোখের কোলেও যে বর্ষার পূর্বাভাস সেটা তিয়াসার নজর এড়িয়ে যায় ।
দেবেশের পরবর্তী কথাগুলি একঝাঁক তীরের মত এসে তিয়াসাকে বিদ্ধ করে ।
" তিয়াসা --আমি ---আমি --আর বাঁচব না রে ---বাঁচব না ---আমার ব্রেন টিউমার হয়েছে রে ---অ্যাডভান্সড স্টেজ ----" ,
দেবেশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না । তার স্বপ্ন -তার আশা , তার সব ---সবকিছু তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে দেবেশ । চোখের বৃষ্টি , মনের বৃষ্টি এত বাঁধ দিয়ে কে বা রাখতে পারে ।
দেবেশের কথা শেষ হতে না হতেই এক আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে তিয়াসার গলার সমস্ত শিরা -উপশিরা ছিঁড়ে , " না --না --না --এ সত্য নয় ---এ হতে পারে না ,না । "
দেবেশ কাঠের পুতুল যেন আজ । যেন ওর যান্ত্রিক হাত তিয়াসার দিকে এগিয়ে দেয় ওর মারণ রোগের সংকেতবাহী মেডিকেল রিপোর্ট । তিয়াসার স্বপ্নগুলো চোখের নিমেষে ভাঙা কাঁচের টুকরোর মত চুরমার হয়ে যায় । কিছুক্ষণ পরে যেন অচেতন কোন অবস্থা থেকে সম্বিত ফিরে পায় ও । খুব অস্ফুটে ওর গলা থেকে বেরিয়ে আসে কটি কথা , " যা হয় হবে , আমার ভাগ্য আমায় যেদিকে নেয় সেদিকেই যাব । আমি তোকে ওই দিনই বিয়ে করব । এর অন্যথা হবে না আর যদি হয় তোর আগেই আমার শেষ দিন আসবে । "
তিয়াসার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে দেবেশের চোখের কোল ছাপিয়ে জল গড়াতে থাকে । ও তিয়াসাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু তিয়াসা ওর মুখ চেপে ধরে ।
আজ ৫ই ডিসেম্বর । অপরূপ সাজে সজ্জিতা কনে তিয়াসা তার পরম চাওয়া দেবেশের গলায় মালা দিয়ে সিঁথির সিঁদুরে রেঙে উঠল ।
আজ ৭ই ডিসেম্বর । তিয়াসা দেবেশের ফুলশয্যা । বেশ কজন মেয়ে -বধূ বেশ খিলখিল হাসিতে তিয়াসাকে দিয়ে গেল ফুলশয্যার পালঙ্কে । অনেক হতাশা , কষ্ট , রোদন -বেদনের মাঝেও তো মানুষ শেষ কোন আশা , কোন ক্ষীণ আলো হাতড়ে বেড়াতে চায় । একটু বেঁচে থাকা , একটু বুক ভোরে নিঃশ্বাস নেয়া পরম চাওয়া , আকুতি হয়ে ওঠে । তিয়াসার তরুণী মন -ওর গভীর ভালবাসা আজ সেই আশার কোন ক্ষীণ আলোর সন্ধান পেতে চায় ।
দেবেশ সুন্দর শেরওয়ানিতে সজ্জিত আজ । কী সুপুরুষ ! কে বলবে ও শরীরে বহন করছে মারণ রোগের সর্বগ্রাসি বিষ । ফুল বিছানো খাটে নতুন কোন স্বপ্ন গেঁথে তিয়াসা একদৃষ্টে দেবেশের দিকে চেয়ে থাকে আর দেবেশ বেনারসি , মালা , চন্দন , সিঁদুরে সজ্জিতা তিয়াসার দিক থেকে যেন চোখ ফেরাতে পারে না আজ । দু -হাতে পরম ভালবাসায় জড়িয়ে ধরে সে তার প্রেয়সী , তার বহুদিনের কাঙ্খিতাকে । এক রোমাঞ্চকর আবেগে তিয়াসা চোখ বুঁজে ফেলে । কিন্তু একী ! দেবেশ তো আর তিয়াসা কে দেখতে পাচ্ছে না । কী যন্ত্রণা ওর সারা মাথায় , এক্ষুণি ফেটে যাবে যেন । ক্রমশ সারা পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল ওর চোখের সামনে । ধীরে -খুব ধীরে ওর নিথর মাথাটা ঢলে পড়ে তিয়াসার কোলে ।
হায় রে আশা - কেন এত ছলনা তোর ! একমুহুর্ত স্তব্ধতা আর এরপর আবার তিয়াসার গলা -বুক চিরে বেরিয়ে আসে হাজার প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া আর্ত চিৎকার , "দেবেশ দা , আমাকে ছেড়ে যাস না , যেতে পারিস না -না -না না -না---- " ,আছড়ে পড়ে ও দেবেশের নিথর দেহে ।
কারা যেন ওর সধবা সাজ খুলে ওকে বিধবা বেশে সাজায় । তিয়াসা সেকথা জানে কী না কিম্বা ওর অনুভুতির কোন গোপন স্তরে ওর হারানো কথা লেখা আছে কিনা জানি না । ও যে কথা বলে নি আর কখনও কোনদিন ।
No comments:
Post a Comment