গল্প
-
ফল্গুধারা
"না করি না, করি না ,করি
না ,আমি একবিন্দু বিশ্বাস করি না তোকে আর সুমন",
শেষ এই কথাটা চিৎকার করে বলে,
দিদি মনি দরজা বন্ধ করে ছিল স্যর। আমায় বিশ্বাস করুন বলে মনি
আঁচলে চোখের জল মুছে পুলিশ কে জানালো।
প্রতিদিনের মতোই তৃষা অফিসের ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরতে প্রায় নয়টা
বেজে যায়।নদীয়ার মফস্বল শহর থেকে কাজের জন্যই তার থাকা সল্টলেকের এই এক কামড়া
ফ্লাট ভাড়া নিয়ে ।বাড়িতে ছোট ভাই এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে,বাবার স্কুল,সেসব ফেলে, কি করে আর মা সঙ্গে আসে!অগত্যা এক
কাজের বিশ্বস্ত দিদি কে নিয়েই তার কলকাতা শহরে সংসার। এই মনি দি,সকাল বেলায় এসে কাজ গুছিয়ে,রান্না,কাচাকাচি সব সামলে আবার ঠিক সন্ধ্যায়
আসে।
কদিন ধরেই মনি দেখছে দিদি খুব চুপ হয়ে গেছে।এই বাইশ তেইশ বছরে মান
অভিমান,প্রেম
প্রীতি এসবের উত্থান পতন যে কেমন আকার নেয় মনি খুব ভালো জানে। আর জানে বলেই নিজের
জীবনের উদাহরণ দিয়ে এক আধ বার সাবধানও করে তৃষা কে। তৃষাও লজ্জায় মুখ লাল করে বলে
"না গো দি,খুব বদমাস জানো তো,আমায় রাগিয়ে মাথা গরম করে তবে শান্তি ওর,আবার
কথা বলবে না,আর আমি ক্ষেপে যাই এমন অবজ্ঞা দেখলে!"
ক্লাস ইলেভেন থেকে চেনা, এই তৃষা কে অয়নের। একটা ফুল ছাপ লং ফ্রক পড়া
ফর্সা দুদিকে বিনুনি করে দুলকি চালে হাঁটা এই মেয়েটিকে প্রথম দেখেই অয়নের খুব ভালো
লেগে গেছিলো। বায়োলজি ব্যাচে লুকিয়ে শুধু তৃষা কে দেখতো শান্ত স্বভাবের অয়ন আর মন
কে বলতো ,"না,প্রেম করা তার
বিলাসিতা হবে"! আসলে খুব ছোটতে বাবা কে হারিয়ে, মা
কে দেখেছে কি ভয়ঙ্কর স্ট্রাগল করতে।
পড়ার একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা ছিল এই দুজনের মধ্যে,অথচ দুজনে কেউ লজ্জায় কথা বলতো
না।ব্যাচে সাপ্তাহিক পরীক্ষা তে দুজনার কেউ প্রথম তো আরেক জন দ্বিতীয় হতো । পর পর
চার সপ্তাহ সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে মুখ গোমড়া তৃষা কে দেখে একবার ইচ্ছে করে একটা
প্রশ্ন ছেড়ে দিতে স্যর খুব অবাক হয়েছিলেন ।অয়নের যে ,আসল
উদ্দেশ্য ছিল একজনের মুখে একটু হাসি দেখার ,সেটা তৃষা খুব
ভালো বুঝেছিলো। আনন্দে আটখানা হয়ে সে সবার অলক্ষ্যে হাত মিলিয়ে ফ্রেন্ডশিপ কার্ড দিয়েছিল
অয়ন কে। তারপর থেকে সব জড়তা কাটিয়ে দুজনেরই,পরস্পরের ওপর
অগাধ ভরসার দিন যাপনের শুরু।
গ্রাজুয়েশন করে তৃষা কলকাতায় চলে এলেও অয়ন,নদিয়ার রানাঘাটেই থেকে যায়
মায়ের সাথে টিউশন ও চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে।কিন্তু তা হলেও ছুটি ছাটা পেলেই
দুজনা দুজনকে সময় দিতো আর রেগুলার ফোন তো ছিলই।গত দুদিন ধরে অফিসে ভীষণ চাপ চলছে তৃষার।নতুন
জব তার ওপর আর একটা নতুন প্রজেক্ট এসে অস্থির করে তুলেছে ওকে। ইদানিং যেন একটু
বেশিই আবেগ আর একটুতেই খিটখিটে মেজাজ হারানোর ঘটনা ঘটছে বারংবার।এর একটা অন্য
কারণও হলো অয়ন কে ফোনেই পাচ্ছে না,দুদিন থেকে।পরশু সেই যে
ঝগড়া করেছে অয়নের সাথে তার পর থেকে চুপ।
মনি দেখেছে একবার দাদাবাবুকে ছবিতে,দেখেই খুব ভালো লেগেছে ।খুব নরম মনের মানুষ টাকে
যখন দিদি ওই ভাবে বলছিল খুব খারাপ লাগছিল মনির।কিন্তু ছোট মুখে বড় কথা কি আর বলবে!
আজ সকালে কলিং বেল টিপে দরজা না খোলা পেতেই বুক টা ধড়াস করে ওঠে মনির। দৌড়ে
সিকিউরিটি কে ডেকে বলতেই সে পাশেই থানা থেকে পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে অজ্ঞান অবস্থায়
হাতের শিরা কাটা, রক্ত মাখা তৃষা কে উদ্ধার করে নার্সিংহোমে
পাঠায়।
লাস্ট কল থেকে নম্বর নিয়ে পুলিশ রীতিমতো হুমকি দেয় অয়ন কে।উদ্বিগ্ন
অয়ন, এমন
ঘটনা যে ঘটে যাবে কল্পনায় ভাবে নি!তাছাড়া এই রবিবার তারা অনেক ক্ষন রাত জেগে গল্প
করেছে।সোমবার অয়নের এক মাত্র অভিভাবিকা সবচেয়ে বড়ো সম্বল মা হঠাৎ করে রাতে মারা
যায় ঘুমের মধ্যেই। অন্তেষ্টি সহ নানান রীতিনীতি খুব ঠান্ডা মাথায় সামলে অয়ন
মঙ্গলবার তৃষা অফিস থেকে ফিরতে ফোন করে । অয়নের কোনো কথা, না শুনে এক নাগাড়ে যা খুশি তাই বলে যায় তৃষা।
পুলিশের কাছে সব শুনে খুব আক্ষেপ লাগে অয়নের।কেবল সোমবার অসুস্থ
মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ফোন না ধরতে পাড়ার এমন খেসারৎ যে তৃষা তার নিজের জীবনের
ওপর এভাবে নেবে শুনেই সিদ্ধান্ত নেয় নার্সিংহোমে যাবে দেখা করতে। যে মানুষ টা
ছায়ার মতো সঙ্গে ছিল তাকে তো চোখের জলে বিদায় করেই এলো কাল,আর যাকে ঘিরে অয়নের এতো
স্বপ্ন সেটা যাতে নষ্ট না হয়,লুকিয়ে এক যাত্রী
প্রতিক্ষালয়ে দাহ করার পোশাক ছেড়ে কলকাতার ট্রেন ধরে।
ঝাঁ চক চকে নার্সিং হোমে পৌঁছাতেই অয়নের হার্ট বিট আরো বেড়ে যায়
লনে দুজন পুলিশ কে দেখে।চুপ চাপ ভিসিটিং হাওয়ারে "তৃষা নন্দী"র বেড
কোথায় জেনে তিনতলায় এমার্জেন্সিতে পৌঁছে দেখে তার তৃষার জ্ঞান ফিরেছে,আজ ই তাকে জেনারেল বেডে দেওয়া
হবে। দুজনে দুজন কে দেখে চোখ ছলছল করে ওঠে উভয়ের। তৃষার হাতে নিজের হাত সঁপে দিয়ে
অস্ফুট কণ্ঠে অয়ন জানায়, "মা আর নেইরে,পরশু মারা গেছে,তোকে আর এভাবে হারাতে চাই না
আমি,এমন পাগলামি কেউ করে রে ,আমায়
একা ফেলে "! "হু হু করে কেঁদে ওঠে তৃষা,তার
ফর্সা গাল বেয়ে অঝোর ধারায় নোনা অশ্রু ধারা পরিবেশ টা কে স্তব্ধ
করে দিয়েছিল খানিক।
দারুন
ReplyDelete