প্রবন্ধ -
বাংলায় বিপ্লববাদ
কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী চিন্তাধারার প্রতিবাদ উনিশ শতকের শেষ দুই দশক ধরে শোনা
যাচ্ছিল৷ধীরে ধীরে চরমপন্থার আত্মপ্রকাশের মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছিল৷চিন্তাগত দিক দিয়ে
চরমপন্থীদের প্রস্তুতি চলছিল পুরোদমে,যা দানা বাঁধতে থাকে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ-নীতির সময়৷বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী তথা স্বদেশী আন্দোলনের সময়
স্বরাজকে মূল লক্ষ্য হিসাবে চরমপন্থীরা গ্রহণ করলেন৷এ' নিয়ে কলকাতা
কংগ্রেসে (১৯০৬) বিতর্ক হলেও অরবিন্দ ঘোষের
নেতৃত্বে চরমপন্থীরা ক্রমাগত এগিয়ে আসছিলেন৷সঙ্গে ছিলেন তিলকের মতো লড়াকু নেতা৷তাঁরা
উপলব্ধি করেন,কংগ্রেসের মধ্যে তাঁদের মত প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন
দল গড়তে হবে৷সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয় তিলক কর্তৃক New Party গঠনের মধ্য দিয়ে৷অজিত সিং-ও গড়লেন 'ভারতমাতা সভা'৷
এই মতেরই আরও স্ফূরণ ঘটল যখন স্বদেশী আন্দোলনের সপক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায়
জেলায় সমিতি স্থাপিত হল৷গৃহীত নীতি কার্যে পরিণত করার জন্য তৈরী হল জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী
দল৷এই সমিতিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বরিশালের 'স্বদেশ বান্ধব',ফরিদপুরের
'ব্রতী',মৈমনসিংহের 'সুহৃদ'
ও 'সাধনা',আর অবশ্যই ঢাকার
'অনুশীলন সমিতি'৷
বাংলায় বৈপ্লবিক কার্যকলাপের প্রস্তুতি অবশ্য কোন নতুন ঘটনা ছিল না৷১৮৬০ ও
১৮৭০-র দশক থেকেই আখড়া বা ব্যায়াম চর্চার
কেন্দ্রগুলিতে শরীর গঠনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনাও চলত৷এইসব
আখড়াই ছিল পরবর্তীকালের গুপ্ত সমিতির বীজ৷তবে এদের সক্রিয়তা শুরু হয় বিংশ শতাব্দী থেকে৷এক্ষেত্রে
কলকাতায় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সতীশচন্দ্র বসু কর্তৃক স্থাপিত 'অনুশীলন সমিতি' ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য৷এর সভাপতি
ছিলেন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র এবং যুগ্ম সভাপতি ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ ও চিত্তরঞ্জন
দাস৷
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় এই সমিতি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে ও অল্প দিনের
মধ্যেই দর্জিপাড়া,পটলডাঙা,খিদিরপুর,হাওড়া,সালকিয়া,বালি,উত্তরপাড়া,শিবপুর,শ্রীরামপুর ও তারকেশ্বরে শাখা স্থাপন করেন৷ঢাকার
অনুশীলন সমিতি শৃঙ্খলা ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে৷আর্মস্ট্রং-এর মতে,এই সমিতিটি ১৯০৫ সালের ৩ নভেম্বর (মতান্তরে ১৯০৬-র সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠিত
হয়৷এর নেতা পুলিনবিহারী দাশ ছিলেন সরলাদেবীর আখড়া থেকে সুশিক্ষিত৷তাঁর অসামান্য কর্মচাঞ্চল্যে
শীঘ্রই আসাম ও পূর্ববঙ্গে অনুশীলন সমিতির ৫০০ টি শাখা গড়ে ওঠে,সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০০৷
অনেকেই স্বদেশী আন্দোলনকে সামনে রেখে চরম বিপ্লববাদের পথে পা বাড়ালেন৷এ' প্রসঙ্গে অধ্যাপক
অমলেশ ত্রিপাঠী চরমপন্থীদের মনে এক কল্পিত গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন
ও অচিরেই স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ হতাশাকে এই ব্যক্তিগত নৈরাজ্যের পশ্চাতে কারন হিসেবে
তুলে ধরেছেন৷এঁরা ভেবেছিলেন,চরম বিপ্লববাদের মধ্য দিয়েই সাধারণ
মানুষের হৃদয়ে বিপ্লবের বাণী পৌঁছে দিতে পারবেন৷এঁদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন অরবিন্দ
ঘোষ৷
অরবিন্দ ও তাঁর সহযোগী যতীন ব্যানার্জী বরোদা থেকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কলকাতায়
আসেন এবং অনুশীলন সমিতির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পাশাপাশি মেদিনীপুরে হেমচন্দ্র কানুনগো,সত্যেন বসু প্রমুখদের
বিপ্লবী মন্ত্রেও দীক্ষা দেন৷এ' ব্যাপারে অরবিন্দ তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার
ঘোষকেও কাজে লাগান৷ক্রমে অনুশীলন সমিতির অভ্যন্তরে পি.মিত্রের
রক্ষণশীল মানসিকতার বিরুদ্ধে একদল তরুণ অরবিন্দের নেতৃত্বে উপ-দল গড়ে তুললেন এবং ইতিপূর্বে সংগঠিত 'আত্মোন্নতি সমিতি'-র সাথে মিশে সেই নামেই শরীরচর্চার পাশাপাশি বৈপ্লবিক আদর্শ প্রচার ও প্রসারে
মনোনিবেশ করেন৷মৈমনসিংহের 'সুহৃদ সমিতি'-র মধ্যেও একইভাবে ফাটল ধরে ও নবগঠিত 'সাধনা সমিতি'
অরবিন্দ,বারীন্দ্রের পথ অনুসরণে প্রবৃত্ত হয়৷
ইতিমধ্যে অরবিন্দ ঘোষের নির্দেশে একদল যুবক মণীন্দ্র লাহিড়ী,অবিনাশ চক্রবর্তী প্রমুখের
আর্থিক সাহায্যে 'যুগান্তর' নামে একটি পত্রিকার
প্রকাশনা শুরু করেন৷ক্রমে এই নামটিই প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে ও 'যুগান্তর'
পত্রিকার পরিচালক ও কর্মীবৃন্দ 'যুগান্তর দল'
নামে অভিহিত হতে থাকেন৷বারীন্দ্রকুমার ঘোষও এই দলের মধ্যে পূর্বস্থাপিত
ছাত্র ভান্ডার,আত্মোন্নতি সমিতি ও চন্দননগরের দলগুলির সমন্বয়
ঘটান৷এ' ব্যাপারে অরুণচন্দ্র গুহের মত প্রণিধানযোগ্য—"...the
starting of Jugantar was the beginning of Yugantar as a separate group—actively
dedicated to the cause of revolutionary movement."
যুগান্তরের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার বৈপ্লবিক আন্দোলনকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে দেয়৷১৯০৬-র মার্চ মাসে
'যুগান্তর' পত্রিকার প্রকাশ ও এর জ্বালাময়ী প্রচারের ফলে
বাংলার যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ বিপ্লববাদে আকৃষ্ট হয়৷এক্ষেত্রে যুগান্তরের পাশাপাশি
অরবিন্দের 'বন্দেমাতরম' ও ব্রহ্মবান্ধব
উপাধ্যায়ের 'সন্ধ্যা' পত্রিকার নামও করা
যায়৷যাই হোক,এসময় অরবিন্দের মুরারীপুকুর রোডের বাড়িতে বারীন্দ্র
অস্ত্র সংগ্রহ ও শিক্ষাদান শুরু করেন৷শুরু হয় বোমা তৈরী৷১৯০৮ সালে এই মুরারীপুকুরের
বাড়িতেই পুলিশের রেইড্ পড়ে ও প্রাপ্ত তথ্যাদি ও অস্ত্রাদির ভিত্তিতে শুরু হয়
'আলিপুর বোমার মামলা'৷এই মামলাই যুগান্তরের সঙ্গে
অনুশীলন সমিতির যাবতীয় সম্পর্ককে ছিন্ন করে৷
এই মূল দুটি সংগঠন ছাড়াও বাংলায় বিপ্লবী মতবাদ নানা দিক দিয়ে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল৷১৯০৬
খ্রিস্টাব্দে বরিশাল প্রাদেশিক সম্মেলনে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচালনার প্রতিবাদে বিপ্লবী
কার্যকলাপ শুরু হয়৷১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে শ্যামজী কৃষ্ণবর্মার সাহায্যে হেমচন্দ্র কানুনগো
বোমা তৈরী করা শিখতে প্যারিসে যান৷ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ডাকাতি,ঢাকার জেলাশাসক অ্যালেন ও অত্যাচারী বিচারক কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা,ইংরেজদের শত্রু দেশগুলির কাছ থেকে ও ভারতীয় বিপ্লবীদের নিজস্ব উদ্যোগে বিদেশ
থেকে অস্ত্র আনয়ন ইত্যাদি কাজ চলতে থাকে৷
তবে এই বিপ্লববাদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি৷এর সাম্প্রদায়িক চরিত্র ও গণসংযোগের অভাব
এর পতনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়৷বারীন্দ্র ঘোষ একবার বলেছিলেন,"রাজনৈতিক হত্যা
যে জাতির মুক্তি আনবে না সে বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ ছিল না,তবু
আমরা সেই পথই বেছে নিয়েছি,কারন সাধারণ মানুষ আমাদের কাছে তা-ই প্রত্যাশা করে৷" তাঁর এই ধারণা ছিল অমূলক৷কারন
গরিব মেহনতী মানুষের কাছে দু' বেলা দু' মুঠো অন্নসংস্থানই ছিল প্রধান৷বরং তাদের জন্য 'বাবু'-দের এই দরদে তারা বিব্রত ও সন্ত্রস্ত হন৷উপরন্তু এই সমিতিগুলি ছিল মূলত
'Gentlemen's Organisation'৷ অশ্বিনীকুমার দত্তের 'স্বদেশবান্ধব সমিতি',অম্বিকাচরণ মজুমদারের 'ব্রতী সমিতি',কেদারনাথ চক্রবর্তী ও ব্রজেন গাঙ্গুলীর
'সুহৃদ সমিতি' ও 'সাধনা সমিতি'-র কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশই ছিলেন উচ্চ-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত৷'অনুশীলন সমিতি' জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা
করতো না এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কাজকর্মে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সুর ধরা পড়ে৷অরবিন্দ
ঘোষ স্বয়ং 'মা'-এর ওপর অধিক নির্ভর করতেন৷ডঃ
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম'
গ্রন্থে যুগান্তর দলের কার্যকলাপ প্রসঙ্গে বলেছেন—"দীক্ষায় সংস্কৃত ভাষা,হিন্দুশাস্ত্র,তরবারি ও প্রতিজ্ঞা বিশেহ উপকরণ ছিল৷...জানি না অহিন্দুর
বেলায় কি ব্যবস্থা হইত৷তবে আসল কথা এই যে,গুপ্ত সমিতিতে অহিন্দু
সভ্য বেশি ছিল না৷" এই মন্তব্য থেকেই গুপ্ত সমিতিগুলির প্রতিক্রিয়াশীলতা
ও রক্ষণশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়৷
তবে ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের ইতিহাসে বৈপ্লবিক আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম৷বিপ্লবের
সূতিকাগার বাংলার বৈপ্লবিক মতবাদের প্রচার ও প্রসার ইংরেজদের সন্ত্রস্ত করে তোলে৷তাদের
মনোবলে চিড় ধরে ও তারা আত্মরক্ষার তাগিদ অনুভব করে৷এই আন্দোলন পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও
অনুপ্রাণিত করে৷বিশেষত তাঁরা বুঝতে পারেন,জনগণকে ব্যতিরেকে কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না৷তাই
পরবর্তী কালের আন্দোলনগুলি ধীরে ধীরে গণ-জাগরণের রূপ নিয়েছিল৷এই
একই সময়ে পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রেও শুরু হয়েছিল বিপ্লবী আন্দোলন,তবে সে অন্য কাহিনী৷
কৃতজ্ঞতা স্বীকার—
১)স্বাধীনতা
সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭)—অমলেশ ত্রিপাঠী
২)ভারতের
জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম (১৮৯৩-১৯৪৭)—সুপ্রকাশ রায়
৩)ভারতের
মুক্তিসংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব—অমলেশ ত্রিপাঠী
৪)বিপ্লব
আন্দোলনের নেপথ্যে নানা কাহিনী—শিশির কর
৫)আধুনিক
ভারতের রূপরেখা—সমর কুমার মল্লিক
------------------------
নির্মলেন্দু কুণ্ডু -মুর্শিদাবাদ
No comments:
Post a Comment