অণুগল্প-
স্বাধীনতা দিবস
আমরা ক’জন ক্লাবের মাঠে প্রভাত-ফেরীর শেষে একটা
সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান দিয়ে, শুরু হবে রক্ত-সংগ্রহের কাজ। এলাকার এম.এল.এ শিবপ্রকাশ তরফদার
সভাপতি। দেবকুমার বাবুও বক্তাদের মধ্যে আমন্ত্রিত। যদিও তিনি খুব একটা মিশুকে নন,
তবু একটু আধটু সাহিত্যচর্চার খাতিরে লোকে তাকে কিছু বলার জন্য ডাকে। তবে আজকাল
দেবকুমারবাবু কয়েকটা বেফাঁস কথা বলে ফেলার দরুন ডাকাডাকি কিছুটা হলেও কমে গেছে।
পাড়ার ছেলেরা যেহেতু ভালো অংকের চাঁদা আর দু একটা
অ্যাড দেববাবুর কাছ থেকে পান, তাই মুখরক্ষার খাতিরে দেববাবুকে ডেকেছেন। তবে
খানিকটা কড়কেও দিয়েছে।
কাকু, যা বলবেন ভেবেচিন্তে বলবেন। আপনাকে নিয়ে চিন্তা।
এম.পি, এম.এল.এ রা আসছেন, বুঝলেন তো। ক্লাবের আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল নয়। ওনারা
খুশি হলে সরকারি সাহায্য আসবে বুঝলেন তো।
দেববাবু বুঝলেন না ক্লাবের আবার আর্থিক স্বাস্থ্যের কি
প্রয়োজন! ভাবলেন আমরাই তো ক্লাবটার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। তখন তো চাঁদার পয়সায় পুজোও
হত, এমনকি বন্যাত্রানেও কিছু খরচা করা হত। এখনো প্রতি বছর বন্যা হয়, কিন্তু....
কিছু বুঝতে পারেন না দেববাবু।
শুধু পাড়ার ছেলেরা নয় গিন্নির কাছ থেকেও বেশ জোরালো ধমক
খেয়েছেন। সত্যি দিনকাল বদলেছে, মেয়েটাও বড় হয়েছে, কথাবার্তা একটু সমঝে বললেই তো হয়
বাপু। কিন্তু ভাষন ছাড়াটা কি সহজ। এ যে এক সাংঘাতিক নেশা। তাই ঠিক করেছেন যা বলবেন
ভেবেচিন্তে বলবেন।
সভাপতির ভাষনের পর দেববাবু উঠলেন। মাইকের সামনে টান টান
হয়ে বলতে আরম্ভ করলেন----
“ নমস্কার, সুধী শ্রোতাবৃন্দ,এবং মাননীয় অতিথিবৃন্দ।
স্বাধীনতা দিবসের এই সুন্দর সকালে, এই যে আপনাদের
রক্তদান উৎসব, এর মত মহৎ উৎসব আর কিছু নেই। মাননীয় সভাপতি মহাশয় যা বললেন, তা
ভীষনভাবে সত্য। এ সময়ে, শুধু এ সময়ে কেন, বছরের সব সময় এ দেশ রক্তাল্পতায় ভোগে।
শুধু তো রোগভোগ নয়, মারামারি হানাহানিরও বিরাম নেই। তাই রক্ত সংগ্রহের এই
আনন্দযজ্ঞে আপনাদের ঐকান্তিক উৎসর্গ অভিনন্দনযোগ্য।
আমার ভেবে আশ্চর্য লাগে, দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, কত
রক্ত ঝড়েছে। কিন্তু এত রক্তদান শিবির আয়োজিত হত কি? এ দিক থেকে স্বাধীনতার পরবর্তী
সময় আমরা প্রভুত উন্নতি করেছি। তবে স্বাধীনতার সাধারন সংগাটা যেন বদলে গেছে।
স্বাধীনতা অবাধ হবে কি নিয়ন্ত্রিত হবে এ প্রশ্নের সম্মুখে দেশ এখন দাঁড়িয়ে।
সর্বোচ্চ আদালত যা বলেন বলুক গিয়ে আমার মনে হয় একটু মেপে কথা বলা, একটু চোখ বন্ধ
রাখার পরিবর্তে যদি শান্তিতে বাঁচা যায়, যদি থানা পুলিশের টানা পোড়েন না চলে তবে
আমি নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার পক্ষে।“
চারিদেকে সাপের ফোসফোসানি শুনতে পেলেন দেবকুমার বাবু।
কান না দিয়ে দেববাবু বলে চলেন---
“পৃথিবীর কোন দেশে অবাধ স্বাধীনতা আছে দেখান তো। তাই
আমি বলি............”
হঠাৎ মাইকটা কোঁ কোঁ করে থেমে গেল। একটা ষন্ডা মার্কা
ছেলে মাইকটা কেড়ে নিয়ে বলল-
“এতো বাজে বকলেন যে মাইকটাও কালা হয়ে গেছে, যান বাড়ি
যান। রাতে বেরোবেন না, আমরা না হলেও বেপাড়ার ছেলেরা ক্যালাতে পারে।“
দেববাবু ভ্যাবলাবাবু হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে ঢুকতেই
মেয়ের আবদার- “বাবা আজ বন্ধুর বাড়ি রাতে নিমন্ত্রন আছে, আড্ডাও হবে, খাওয়া দাওয়াও
হবে। আমায় ছেড়ে দিয়ে এসো না প্লিজ”
দেববাবু হঠাৎ যেন ক্ষেপে গেলেন “বড্ড স্বাধীন হয়েছ না? রাত বিরেতে আড্ডা
মারা! ৮ টার পর থেকে ক্লাব-মোড়ে মাতালদের ফিষ্ট চলবে। আর ওখান দিয়ে আমি ওকে নিয়ে
যাব! যা আজ ঘরের বাইরে এক পা ও বেরোবি না”
-----------------------------------------------------
সঙ্গীতময় দাস- কলকাতা
No comments:
Post a Comment