গল্প -
মিমির মুক্তি
আজ রবিবার, সবার কাছেই এটা ছুটির দিন । কিন্ত
মিমির কাছে আতঙ্কের । কারন আজ তো ওর নাচ, আকা, সাঁতার, অংক
আর ইংলিশ ক্লাস আছে । মাঝে ঘন্টা দুয়েকের ছুটি, ব্যাস
ওইটুকুই । মিমি একটা নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্রী । এখন থেকেই
ওর সব বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষক - শিক্ষিকা রয়েছেন । সাথে নাচ সাঁতার, আঁকা
এসব ও আছে । মায়ের ভীষণ ইচ্ছা মিমিকে বড় সাঁতারু করার । কিন্ত বাবার ইচ্ছা মিমি
বড় ডাক্তার হবে । বাবা- মায়ের ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে ও প্রায় হাবুডুবু খাচ্ছে । তার
উপর আবার এবারে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় সব বিষয়ে পুরো নম্বর পায়নি বলে মা-বাবা ভীষণ
রেগে আছেন । ওর খেলাধুলো, বাইরে বেরোনো সব বন্ধ করে দিয়েছেন
। মাঝে মাঝেই ওর মনে প্রশ্ন জাগে যে, এমন
কেউ নেই যিনি ওকে এই বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে পারেন? কিন্ত
উত্তর দেওয়ার মত কেউ নেই ।
এইসব ভাবতে ভাবতে জলখাবার খাচ্ছিল
মিমি । হঠাৎ
কার গলার স্বর শুনে চমকে গেল । " কেমন আছ দিদিভাই? " মিমি ঘুরে দেখে দাদুন দাঁড়িয়ে । এই মানুষটাকে খুব ভাল
লাগে মিমির । কারন দাদুন ই একমাত্র ওর কষ্ট বুঝতে পারেন । ঠাম্মি মারা যাওয়ার পর
থেকেই উনি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ান । বছরে একবার করে এসে কিছুদিন ওদের বাড়িতে থেকে যান । দাদুনকে
দেখেই মিমি সব কিছু ফেলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল । " কেমন আছ তুমি? কখন
এলে? আমার জন্য কী এনেছ? " " দাঁড়া!
দাঁড়া! এত প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি তো হাঁপিয়ে যাব । তার চেয়ে চল তুই- আমি
আজ সারাদিন বসে গল্প করব । মিমির মুখটা পলকে উদাস হয়ে গেল । তাহলেই হয়েছে! আমার তো
আজ পড়া নাচ সবই আছে ।দূর পাগলি আজ তোর ছুটি ।কথাটা শুনে মিমির মনে খুব আনন্দ হল । কিন্ত পরমুহূর্তেই সব আনন্দ নিভে
গেল । কারণ ঠিক তখনই মা এসে ওকে তাড়া দিল " চল চল! রেডি হয়ে নে । দেরী হলে সাঁতার শুরু হয়ে
যাবে তো ।" দাদুন মাকে বারণ করবার সুযোগই পেলেন না । মিমিও বাধ্য মেয়ের মত
মায়ের পিছন পিছন চলে গেল । দাদুন মিমির করুণ মুখটা দেখে বেশ কষ্ট পেলেন ।
এর পরের কয়েকদিন মিমির রোজনামচা
লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন যে মেয়েটির ওপর কী অসম্ভব চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে । সব দেখে
তিনি ঠিক করলেন এই সমস্যার সমাধান তাঁকেই করতে হবে । পরের দিন রবিবার, ফলে
সবার ছুটি, মিমি ছাড়া । জলখাবার খেয়ে মিমি বেরিয়ে যেতেই দাদুন তাঁর
ছেলে- বৌমাকে ঘরে ডাকলেন । " বাবা তুমি আমাদের ডেকেছ? " ছেলে জানতে চাইল । " হুমমম, তোমাদের সাথে একটু দরকার
আছে আমার । বোসো । " দুজনে চেয়ারে
বসতেই দাদুন ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দরজাটা আটকে দিলেন । ওরা দুজনেই এই ঘটনায় অবাক হয়ে গেল । সেইসঙ্গে দরজায় ধাক্কা
দিতে শুরু করল । কিন্ত কেউ দরজা খুলে দিল না । দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেল ।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর দাদুন ই
দরজাটা খুলে দিলেন । " কী খুব ভয় পেয়ে গেছ না তোমরা? " দুজনেই হাঁ করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল । " এই
ঘন্টাখানেক একটা ঘরে আটকে থেকে তোমরা ভয় পেযেছ, হাঁপিয়ে
উঠেছ । তাহলে একবার ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা ভাবো, যে
বছরের পর বছর এইভাবে আটকে রয়েছে শিক্ষার জালে ।ওর কত কষ্ট হচ্ছে বলো তো? তবুও
ওর মুখে একটা কথা নেই । ওর কষ্টটা একবারও বোঝার চেষ্টা করেছ? " এই
প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই ওদের কাছে
দুজনেরই মাথা নীচু!! দাদুন আবার
বললেন " আচ্ছা খোকা? তুই যখন ছোট ছিলিস, তখন
তো বেশিরভাগ দিনই স্কুলে যেতিস না । সারাদিন
মাঠে- ঘাটে খেলে বেড়াতিস, পড়াশোনাতেও
খুব একটা ভাল ছিলিস না । কিন্ত তা নিয়ে কী আমরা কোনোদিন কেউ কিছু বলেছি? তোর
স্বাধীনতায় কোনও বাধা দিয়েছি কী? " দাদুনের কথা শুনে মাথা হেঁট করে দাড়িয়ে রইল । " এত কিছু সত্ত্বেও
তুই বড় ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছিস । তাই তো? " মিমির
বাবা এখনও চুপ । " কিন্ত বাবা! আপনি বুঝতে পারছেন না । এটা প্রতিযোগিতার যুগ । এখানে
পিছিয়ে পড়লে ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার । " " আচ্ছা
বৌমা আমি শুনেছিলাম তুমি কলেজ পর্যন্ত বাবা- মায়ের কাছেই পড়াশোনা করেছ!!!! তুমিও
বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে!!! কই তুমি তো খারাপ হয়ে যাওনি??
তাহলে? " না এই প্রশ্নেরও উত্তর নেই । দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল
। " যে স্বাধীনতা নিজেরা উপভোগ করেছ, আজ
নিজেদের মেয়েকে তা দিতে এত কৃপণতা কেন? যুগ
যতই এগিয়ে যাক না কেন, যে বয়সের যা উপযুক্ত, সেটা
করাই বাঞ্ছনীয় । আশা করি এরপর থেকে মিমিকে তোমরা পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে । "
দাদুনের কথা আর শিক্ষা বোধহয় দুজনের চোখ
খুলে দিল । এরপর থেকে ওরা মিমিকে জোর করে কিছু করতে বলেন না । বাঁধাধরা জীবন থেকে
মিমির মুক্তি ঘটেছে । এতে মিমিও ভীষণ খুশি । মিমি এখন রোজ বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে
মাঠে খেলতে যায় । নিজের মন যা চায় তা করতে পারে, তবে
কখনোই পড়ায় ফাঁকি দিয়ে নয় । দাদুন বলে গেছেন, এবারে
মিমিকে সব বিষয়ে পুরো নম্বর তুলতে হবে । মিমি অবশ্যই চেষ্টা করছে দাদুনের কথা
রাখতে ।
-----------------------------------------------------
Sukanya Mullick
Nandipara Lane, Ramrajatala, Howrah.
No comments:
Post a Comment