অণুগল্প -
মুক্তি
অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতি বৃহস্পতিবার এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের গায়ে লেগে থাকা দোকানটাতে ঢুঁ মারা এখন একপ্রকার অভ্যাসের মতই হয়ে গেছে বিপ্রতীপ-এর। গত সাতমাসের রুটিন এটাই। অথচ এমনটা যে হতে পারে সেটা কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর বিপ্রতীপ শুধুই বিজ্ঞান পড়েনি; সে ছিল প্রকৃতই বিজ্ঞানমনস্ক। এই শহরতলির যুক্তিবাদী সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সে-ই ছিল একথা এতদঞ্চলের সবাই জানে। তবু কিনা সেই... নিজেই অবাক হয় বিপ্রতীপ। আসলে সময় যখন কঠিন হয়, বিরূপ হয়, তখন আচ্ছা আচ্ছা মহাপুরুষও ভাগ্য আর অদৃষ্টে বিশ্বাস করতে শুরু করে। অফিসের গোলমালটা যেন পিছু ছাড়তেই চাইছে না। প্রতি সপ্তাহেই পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত ছ'মাসে এই নিয়ে সতেরোজনকে নোটিস ধরানো হয়েছে। প্রত্যেকে আতঙ্কে ভুগছে, এই বুঝি তার নামটা চাকরিহারাদের দলে ভিড়ে গেল। তাই তার স্ত্রী কেতকীর বারংবার অনুরোধের সামনে তার সাহসের বাঁধটা একদিন ভেঙেই গেলো। কেতকীর গুরুদেবের প্রেসক্রিপশনটা মানতেই হলো বিপ্রতীপকে।
আজকেও জিনিসগুলো অর্ডার দিয়ে একমনে নিজের অদৃষ্টের কথাই ভাবছিলো বিপ্রতীপ। হঠাৎ কাঁধে হাত ও চেনা একটা কন্ঠস্বরে সম্বিত ভাঙলো তার। "কি ব্যাপার রে বিপ্র", এ তো তার সহপাঠী অভিযান, "তুই হঠাৎ এই দোকানে? এ তো ভূতের মুখে রামনামের চেয়েও বড় খবর রে!" প্রাথমিক ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে সপ্রতিভতার সঙ্গেই জবাব দিল বিপ্র, "শালীর ছেলের সামনেই মাধ্যমিক, তাই তার অনুরোধেই এই ঢেঁকি গেলা বলতে পারিস", চোখ টিপুনি দিয়ে মুখের হাসিটা বজায় রাখল বিপ্র। সন্দিগ্ধ চোখে বিপ্রর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে "ও, তাই বল", বলে এগিয়ে গেল অভিযান। নাঃ, হাজার চেষ্টা করেও লুকিয়ে রাখা গেল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিপ্র।
সাধুগলির অন্ধকার মোড়টায় খপ্ করে বিপ্রর হাতটা চেপে ধরল অভিযান, "হেরে যাসনা বিপ্র", গলায় আন্তরিকতার স্পষ্ট ছোঁয়া অভির, "তুই যে আমাদের অনেকের আদর্শ রে। ঢেউয়ের বিরূদ্ধে বরাবর চলেই যে তুই বিপ্রতীপ"। চলে গেল অভি, ঠায় দাঁড়িয়ে কাঁপছে বিপ্র। পকেট থেকে খামে মোড়া শিকড়ের প্যাকেটটা বার করে ছুঁড়ে ঘোষপুকুরের জলে ফেলে দিল সে। নাঃ, মুক্তিটা আজ, এই মুহূর্তেই পেতে হবে, ভাবলো বিপ্রতীপ, এখন সে স্বাধীন।
---------------------------
সঞ্জীব "অধম" মুখোপাধ্যায়।
ঠিকানা: এম. এস. মুখার্জী রোড, খড়দা।
No comments:
Post a Comment