গল্প-
সারে জাঁহাসে আচ্ছা
১৪ই অগাস্ট, রাত দশটা, শিয়ালদা স্টেশন
-“এদের জন্য চলাফেরা করার উপায়
নেই...প্ল্যাটফর্মটাকে ঘরবাড়ি বানিয়ে রেখেছে” গজগজ করতে করতে এগিয়ে গেল একদল লোক।
দুএকজনের পায়ের ধাক্কায় কঁকিয়ে উঠলো নিতাই। পাদুটো কাছে টেনে নিজেকে গুটিয়ে নিল
নিতাই। রাত হয়েছে। দার্জিলিংয়ের গাড়িটা বেরিয়ে যেতে পল্টুর দোকানে ভাত খেয়ে এসে
শুয়েছিল নিতাই। স্টেশনে আজ বাড়ি ফেরার ঢল! ছুটির দিনের আগে হয়। পল্টু বলছিল কাল সেই দিনটা! দেশ
স্বাধীন হয়েছিল কাল। ছুটির দিনে নিতাইয়ের কামাইয়ের
দফারফা। কাল আবার নতুন গাড়ীর ফিতে কাটতে রেলমন্ত্রী আসবে নাকি। স্টেশন চত্বরে কাল
ওদের ঠাঁই হবে না। দুদিন ধরে পুলিশ আসছে, আজ তো একেবারে ভরে গেছে। বৃষ্টি বাদলের রাত বলে রেয়াত
করেছে, কাল সক্কাল হতে না হতেই ভাগাবে
নিতাইদের।
-“আমরা কেন দেখবোনি ফিতে কাটা?” ওফ, এই বেলালকে নিয়ে তো মহা জ্বালা!
দুদিন হল এসে জুটেছে এখানে। অল্প
বয়স ছেলেটার, এই লাইনে বেশিদিন নেই দেখলেই
বোঝা যায়। মুখে একটা বীভৎস কাটা দাগ, যে কারোর ভয় করবেই দেখলে। ওইজন্য কোথাও কাজ পায় না বেচারা। তাই ভিক্ষা না করলে তো খেতে পাবে
না।
-“কেন অতশত বুঝি না, আমাদের মানা আছে সেটাই জানি”
-“আমি দেখবোই কাল ফিতে কাটা, তোমারে এই বলে দিলাম” মুশকিলে ফেললে তো! কাঁচা বয়স! কি
করতে কি করবে, শেষে পুলিশে না ধরে। চোখে চোখে রাখতে হবে।
৭ই অগাস্ট, ক্রাইম ব্র্যাঞ্চ, দিল্লী হেড কোয়ার্টারস
-“এরকম খবর আসতেই থাকে, ছাব্বিশে জানুয়ারি আর পনেরোই অগাস্টের আগে”
-“স্যর, জেনুইন সোর্স থেকে এসেছে
খবরটা। নেগলেক্ট করা ঠিক হবে না”
-“যাইহোক, মিনিস্টারের
প্রোগ্রামের কোনো চেঞ্জ হবে না। বি
অ্যালার্ট”
-“প্রোগ্রাম না, আমি ডিউটি চেঞ্জ করার কথা বলছিলাম স্যর। সিকিয়োরিটি-ইন-চার্জ হিসেবে যদি অন্য কাউকে…”
-“হোয়াট ডু ইউ মীন! তুমি কি বলছ
জানো! এসব কাজে সেনগুপ্তর এফিসিয়েন্সি প্রশ্নাতীত। চার্জে ওই থাকবে।”
-“ওকে স্যর। ওয়ান লাস্ট রিকোয়েস্ট!”
-“আই নো ইয়ং ম্যান! সোর্সের খবরটা
টপ সিক্রেট থাকবে।”
বসের ঘর থেকে বেরিয়ে হিমাদ্রির
মুখে চিন্তার রেখাগুলো আরো স্পষ্ট হল। স্বাধীনতাদিবসে
শিয়ালদা স্টেশনকে টার্গেট করেছে।
নতুন ট্রেনের উদ্বোধন করতে রেলমন্ত্রী থাকবেন স্টেশনে, সেই সাথে রাজ্যেরও কিছু মন্ত্রী, আমলারও থাকার কথা। আতঙ্কবাদীদের
জন্য একেবারে আদর্শ মঞ্চ। এটা এড়াতে সিকিয়োরিটি টাইট করতে
হবে। তবে হিমাদ্রিকে ভাবাচ্ছে একটা
তথ্য। ওদের প্ল্যানটা নাকি ফুল প্রুফ। কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। টেররিস্টরা এতটা কনফিডেন্স তখনি
পায় যখন বড়সড় কাউকে হাত করতে পারে। সোর্স
ডিকোড করেছে মেসেজটা “গট আ বিগ ফিশ ইন নেট…”
কোন বড় মাছ ওদের জালে ধরা দিল, না জানা অব্ধি চিন্তা দূর হচ্ছে না হিমাদ্রির।
১৫ই অগাস্ট, ভোরবেলা, শিয়ালদা স্টেশন
বড় বেগ আসায় অন্ধকার থাকতে ঘুম
ভেঙে গেল নিতাইয়ের। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে
রেল কোয়ার্টারে যাওয়ার রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কাজ সেরে নিল নিতাই। এই দ্যাখো, বেলাল আবার কোথায় গেল এইসময়। ওর পাশেই শুচ্ছে ছেলেটা। একটু আগেই দেখে গেল ঘোড়া বেচে
ঘুমোচ্ছে। কে জানে ওর মতই কাজ করতে গেছে
হয়ত। টুকটাক যা মাল আছে দুজনের গুছিয়ে
নিচ্ছিল নিতাই। তখনি ওর নজরে এল মোবাইল ফোনটা, বেলালের! চালচুলো নেই ছেলের। এদিকে আবার ফোন কিনেছে। মাঝেমধ্যেই লাইট জ্বলছে
মোবাইলটায়। তাক লেগে গেল নিতাইয়ের। বেলাল হয়ত এখনি এসে পড়বে। তার আগেই মোবাইলটা সরিয়ে ফেলতে
উদ্যত হল নিতাই।
১৫ই অগাস্ট, সন্ধ্যে ছটা, শিয়ালদা স্টেশন
মাইকের আওয়াজ দূর থেকে শোনা
যাচ্ছে। মন্ত্রীর ভাষন শেষ, এবারে ফিতে কাটা হবে। আজ দুপুরের পর থেকেই স্টেশন চত্বরে খুব কড়াকড়ি। পল্টু বলছিল, সন্দেহের বশে কয়েকজনকে পাকড়াও করেছে পুলিশ! বেলালকে অনেকক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না ও। পুলিশে ধরল কিনা কে জানে।
ভোরবেলায় ওর মোবাইলটা হাতিয়ে নিয়েছিল নিতাই। ব্যাটা ফিরে এসে খোঁজ করছিল। নিতাইকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করল, ওর সব জিনিস নিয়েছে কিনা। নিতাই কিচ্ছুটি বুঝতে দেয়নি। নিজের প্লাস্টিকে মোবাইল তড়িঘড়ি ঢুকিয়ে নিয়েছিল। তবে এত সুন্দর ফোনটা, ভোগে লাগলো না। বাইরে এক জায়গাতে সুস্থির হয়ে বসে ফোনটা খুঁজতে গিয়ে দেখে নেই! কোথাও পড়ে গেল বা কেউ ঝেড়েও দিতে পারে। যাক গে, কি আর করা যাবে। সবকিছু মিটলে স্টেশনে ফিরতে পারলে এখন বাঁচে নিতাই।
১৫ই অগাস্ট, বিকেল চারটে
কারশেড থেকে নতুন ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে প্ল্যাটফর্মে। এটারই উদ্বোধন হবে আজ। মন্ত্রী ফিতে কেটে দিলে ট্রেন যাত্রী বোঝাই হয়ে চলবে আজই। মাছি না গলা নিরাপত্তা চারদিকে। তবু সিকিয়োরিটি-ইন-চার্জ মিঃ সেনগুপ্ত নিজে প্রতিটি কম্পার্টমেন্ট চেক করছেন। ইঞ্জিনের পরের কামরা ভাল করে চেক করেও কি মনে করে টিমকে বাইরে রেখে টয়লেটে ঢুকে পড়লেন একাই। কমোডটায় কিছু একটা নজরে এল মিঃ সেনগুপ্তর। ভালো করে বুঝতে গ্লাভস পড়া হাতটা ঢুকিয়ে দিলেন কমোডের ভেতরে। কিন্তু বের করে আনতে পারলেন না হাতটা। কমোডের আউটলেট আর লাইনের মাঝের ফাঁকা জায়গা থেকে পাথরের মত শক্ত একটা হাত এসে ওনার হাতটা চেপে ধরল। ছাড়াতে পারলেন না তিনি।
১৫ই অগাস্ট, লালবাজার
ইন্টারোগেশন রুম, রাত আটটা
মিঃ সেনগুপ্তর সামনে বসা ছেলেটার মুখে একটা বীভৎস কাটা দাগ। কোমডের গর্তের ভেতর থেকে এর হাতটাই এসে ধরেছিল সেনগুপ্তর হাত। ছেলেটা ট্রেনের তলায় লুকিয়ে বসেছিল সুযোগের অপেক্ষায়।
"মিঃ সেনগুপ্ত, বিগ ফিশটা তাহলে আপনিই" মেকাপ সরানোর পরে এবারে ভদ্রস্থ দেখাচ্ছে বেলাল ওরফে হিমাদ্রির মুখটা। সেনগুপ্তকে হাতেনাতে ধরতে ছদ্মবেশ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সিকিয়োরিটি-ইন-চার্জ সেনগুপ্ত নিজে হাতে টাইমার ফিট করবেন, এটাই ওদের ফুল প্রুফ প্ল্যান ছিল। বসের নির্দেশে হিমাদ্রি আণ্ডার কভার থেকে পুরো অপারেশনটা সাফল্যের সাথে পরিচালিত করেছে। শুধু নিতাই হিমাদ্রির ফোনটা সরিয়ে দিয়েছিল বলে প্রবলেম হয়েছিল, তাও অল্প সময়ের জন্য। যাইহোক, বিপদটা এড়ানো গেছে। নতুন ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়েও গেছে সময়মত।
কোথাও মাইকে বাজছে “সারে জাঁহাসে আচ্ছা…”
-সমাপ্ত-
---------------------------------------------------------
Ansu Pratim De 6(7/A) Panpara(chatal), Barrackpur, Po- Talpukur, Dist- 24 Parganas
(North) Kolkata 700123
No comments:
Post a Comment