Tuesday, August 14, 2018

ধরিত্রী গোস্বামী


অণুগল্প-   
স্বাধীনতা দিবস


তোর্সার জলে ভেসে গেছে পুরো গ্রাম। নাগাড়ে বৃষ্টি চলছে প্রায় পাঁচ দিন হল। আজ সকালে উঠে জানলার বাইরে তাকিয়ে চিমা দেখল মেঘের আড়াল থেকে একটু রোদ উঁকি দিচ্ছে। আনন্দে বুকের ভেতরটা নেচে উঠল। আজ যেন আর বৃষ্টি না হয়। আজ যেমন করে হোক স্কুলে যেতেই হবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হতে লাগল মেয়ে।
বুকজল ঠেলে সকাল সকাল স্কুলে পৌঁছে গেছেন এমান খোন্দকার। আজ কুড়ি বছর ধরে এখানকার হেডমাস্টার। রিটায়ার হতে আর বছর দুই বাকি। এক গাল মেহেন্দি করা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে চিন্তা করছেন আজ কি হবে? বাচ্চারা কেউ কি স্কুলে আসতে পারবে? কি ভাবে সম্ভব এতটা আসা করা। ঘরে ঘরে জল ঢুকে গেছে, খাবার নেই, জ্বালানি নেই, সরকারি রিলিফ এখনও পৌঁছায়নি। খালি পেটে বাচ্চাগুলো এসে দাঁড়ালে তিনি কি বা দেবেন ওদের হাতে?
বাগানের গাছে এক কাঁদি কলা পেকেছিল। তারই কিছু খেয়ে দিন গুজরান করছে ইস্পা আর ওর বাবা মা। ঘরে আর খাবার তেমন কিছু ছিল না এই কদিন। আজ রোদ উঠছে দেখে ইস্পার মনে আশা জাগল। তাহলে স্কুলে যেতে পারবে। তরুণ স্যার বলেছিলেন আজ আসতেই হবে। স্যারকে খুব ভালবাসে ইস্পা। স্যার কত গল্প বলেন ক্লাসে। রাজাদের গল্প, যুদ্ধের গল্প। সব নাকি  ভারত বলে যে দেশে ইস্পা থাকে, সেই দেশেরই গল্প। সে নাকি অনেক বড় অনেক ধনী অনেক গৌরবময় এক দেশ। শুনলেই বুকের মধ্যে যেন টগবগ ঘোড়া ছুটে যায় ইস্পার।
জলপাইগুড়ি শহরের ছেলে তরুণ বর্মণের নতুন চাকরি এই প্রত্যন্ত গ্রামীণ স্কুলে। অঙ্কের ছাত্র হলেও তাকে বাংলা ইংরাজিও পড়াতে হয়। তবে পড়াবার থেকে বাচ্চাগুলাকে গল্প শোনাতে তার বেশি ভাল লাগে। নিজের এখনও পরিবার সংসার বলে কিছু নেই। এই প্রাইমারি স্কুলে নেপালি, গোর্খা, রাজবংশি আর টোটো উপজাতির বাচ্চারা পড়ে মিলিয়ে মিশিয়ে। তাদের নিয়েই তরুণের দিন কাটে।
হেড মাস্টারের ঘরে রাখা পুরানো জং ধরা ট্রাঙ্কটার ডালা খুলে ভেতর থেকে জাতীয় পতাকাটা বার করলেন এমান সাহেবপ্রতিবছর দুবার করে বার করা হয়। ১৫ই আগস্ট আর ২৬শে জানুয়ারি। তারপর আবার যত্ন করে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখা  হয়। ভাগ্যিস স্কুলের জমিটা অনেক উঁচু। নাহলে জল যদি এখানেও উঠে আসত তাহলে কি আর রক্ষা থাকত? পতাকাটা বুকের  ওপরে রেখে চোখ বন্ধ করেন এমান সাহেববন্ধ চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে ঠাকুরদাদার মুখ। নোয়াখালির দাঙ্গার সময়ে গান্ধিজির সঙ্গে হেঁটেছিলেন অনেক পথ। মানুষের দুঃখ দুর্দশা অনেক দেখেছেন। সেই সব গল্প নাতিকে শোনাতেন শেষ বয়সে। বলতেন, মানুষের একটাই ধর্ম, ভালবাসা।
বাইরে থেকে আসা একটা হট্টগোলে ঘোর কাটে এমান সাহেবের। তরুণ গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে স্কুলের দিকে আসছে। দুর্গম গিরি কান্তার মরু...।সঙ্গে কচিকাচাদের হুল্লোড়। তরুণের কাঁধে চড়ে আসছে চিমা আর লিম্বু। যা জল, নিচে নামলে ওরা তলিয়ে যাবে। পিছনে আরও ছেলেরা, জলের ওপর শুধু তাদের মুণ্ডুগুলো ভেসে আছে। ইস্পার মাথায় কলার কাঁদি, বিরুর মাথায় একটা ডেচকিতে ওর মা কিছু ডিম সেদ্ধ করে পাঠিয়েছেন, জগতের মাথায় ফুলের সাজিতে কিছু জবা আর গাঁদা ফুল ওরা দল বেঁধে আনন্দ করতে করতে স্কুলে আসছে। পতাকা তুলবে।  
আজ যে স্বাধীনতা দিবস। 
------------------------------  
ধরিত্রী গোস্বামী -খড়গপুর



No comments:

Post a Comment