নিবন্ধ -
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়া
ভারতের
স্বাধীনতা অন্দোলনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে কত স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম, যারা ভারত ভূখন্ড থেকে ইংরেজদের উচ্ছেদ
করার ব্রত নিয়ে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে মাস্টারদা
সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম
বসু থেকে শুরু করে বিনয়-বাদল-দীনেশের বৈপ্লবিক
কার্যকলাপ আজও ভারতবাসী তথা বাঙালী মননে গেঁথে আছে। তারই মাঝে অনেকেই আছেন যাদের বৈপ্লবিক
কার্যকলাপ ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে, কিন্তু তাদের নাম
অনেকেই হয়তো জানেন না বা স্মরণ করেন না। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তাঁদের মধ্যেই
একজন যার মহান কার্যকলাপ সম্বন্ধে অনেকেই জানেন না। তেমন ভাবে আর একজনের নাম মদনলাল ধিংড়া, যিনি ছিলেন ভারতীয়
উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের
বিপ্লবী।
মদনলাল ধিংড়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অসামান্য বিপ্লবী
ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে অধ্যয়নরত ছিলেন যেখানে
তিনি ব্রিটিশ কর্মকর্তা স্যার উইলিয়াম হার্ট কার্জন উইলিকে
গুলি করে হত্যা করেন। বিংশ শতাব্দীতে এই ঘটনাটি ভারতীয়
স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ঘটনাগুলির মধ্যে একটি।
১৮৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে একটি সমৃদ্ধ
হিন্দু পরিবারে মদনলাল ধিংড়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন।এক সিভিল সার্জন পিতার সাত সন্তানের
ষষ্ঠ সন্তান ছিলেন মদনলাল ধিংড়া। তিনি তাঁদের পরিবারের
ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মানুষ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মাতা একজন ধর্মীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতির ভক্ত ছিলেন, যার প্রভাব তাঁর মধ্যে পড়েছিলো। তিনি ছাড়া তাঁর বাকি ভাইদের শিক্ষা
ইংল্যান্ডে হয়েছিলো। মদনলাল ধিংড়া অমৃতসরের এম.বি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে
১৯০০ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য লাহোরের সরকারি
কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময় ছাত্ররা যে
ব্লেজার পড়তো তা ইংল্যান্ড থেকে আমদানী হত। ১৯০৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্লেজারের
কাপড় আমদানী করার প্রতিবাদে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন হয়, যে আন্দোলনের নেতৃত্বে
ছিলেন মদনলাল ধিংড়া। তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সময়ে ধিংড়া মাস্টার অফ আর্টসের
ছাত্র ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদী স্বদেশী আন্দোলনে
প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ভারতের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের
ব্যাপক কারণগুলি নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং অনুভব করেন যে এই সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য
দরকার স্বদেশী আন্দোলন। ধিংড়া এরপর ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেছেন, তারপর সিমলাতে ব্রিটিশ
পরিবারগুলির মাল পরিবহনের জন্য কলকার একটি টাঙ্গা পরিষেবায় কাজ করেছেন। তারপর
একটি কারখানার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। এখানে তিনি একটি ইউনিয়ন সংগঠিত করার
চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর তিনি মুম্বাইয়ে কিছু সময়ের জন্য
কাজ করেছিলেন।
তারপর তিনি তাঁর বড় ভাই ডাঃ বিহারী লালের পরামর্শে উচ্চশিক্ষা
চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইংল্যান্ড যান ১৯০৬ সালে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে মেকানিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার জন্য প্রথমদিকে তাঁর বড়
ভাই এবং পরে ইংল্যান্ডে কিছু জাতীয়তাবাদী কর্মী তাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন।
লন্ডনে মদনলাল ধিংড়ার সাথে পরিচয় হয় সেই সময়ের প্রখ্যাত
বিল্পবী নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মার সাথে। এই দুই বিপ্লবী ধিংড়ার প্রচন্ড দেশভক্তিতে
মুগ্ধ হয়েছিলেন। জানা যায়, বিনায়ক দামোদর সাভারকরই
মদনলাল ধিংড়াকে 'অভিনব ভারত' নামে একটি
বৈপ্লবিক সংগঠনের সদস্য করান এবং বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। মদনলাল ধিংড়া লন্ডনের 'ইন্ডিয়া হাউস'-এ বেশি থাকতেন। সেইসময় এই হাউস ভারতীয় বিদ্যার্থীদের
রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মূল কেন্দ্র ছিল। এই সকল বিপ্লবী বিদ্যার্থীরা সেইসময়
ভারতে ক্ষুদিরাম বোস, কানাইলাল দত্ত, সতিন্দর পাল এবং কাশীরামের মত বিপ্লবীদের
মৃত্যুদন্ড দেওয়ার জন্য ভীষণ রকম ভাবে ইংরেজ সরকারের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন। কিছু ইতিহাসবিদ এটাই মনে করেন এই সকল
মৃত্যুদন্ডের ঘটনাগুলো সাভারকার এবং ধিংড়াকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বদলা
নেওয়ার জন্য ইন্ধন জুগিয়েছিলো। তাঁরা সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
১৯০৯ সালের ১লা জুলাই সন্ধ্যায় লন্ডনের একটি হলে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল
অ্যাসোসিয়েশন’-এর একটি বার্ষিক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। যে সভায় অংশগ্রহণ করতে বেশ কিছু ভারতীয়র
সাথে ইংরেজরাও একত্রিত হয়েছিলো। ঐ সভায় মদনলাল ধিংড়াও উপস্থিত হয়েছিলেন। ঐ সভায় যোগদান করতে আসার কথা ভারত
সচিবের পরামর্শদাতা রূপে ব্রিটিশ কর্মকর্তা স্যার উইলিয়াম হার্ট কার্জন উইলির। সভা শেষ হওয়ার পর যখন অতিথিরা যে যার
মত হল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেইসময় ধিংড়া উইলিয়াম হার্ট কার্জন উইলিকে নিশানা করে
পাঁচটি গুলি করেন। যার মধ্যে চারটি গুলি সঠিক নিশানায়
লাগে। এছাড়াও তাঁর গুলিতে মারা যান ডাঃ লালকাকা, যিনি একজন পার্সিয়ান
ডাক্তার। এরপর ধিংড়া নিজের জন্য বরাদ্দ রাখা
একটি গুলি নিজের ওপর প্রয়োগ করতে যাবেন কি তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।
২৩শে জুলাই ১৯০৯ সালে ধিংড়ার শুনানি হয় লন্ডনের পুরোনো বেলি
কোর্টে। আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। তারপর ১৭ই আগষ্ট ১৯০৯ সালে লন্ডনের
পেন্টবিলে জেলে তাঁকে ফাঁসী দেওয়া হয়। তাঁর এই মৃত্যু ব্যর্থ হয়নি। মদনলাল ধিংড়া স্বদেশী আন্দোলনের জন্য
নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাঁর এই আত্মবলিদান ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক
আন্দোলনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। মৃত্যুবরণ করেও মদনলাল ধিংড়া অমর হয়ে
রয়েছেন। ভারতবর্ষের শহীদ বিল্পবীদের তালিকায়
তাঁর নাম আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। হয়তো অনেকেই জানেন না তাঁর এই বলিদান, কিন্তু এখনো বিপ্লবী
মদনলাল ধিংড়ার স্মারক রয়েছে রাজস্থানের আজমের রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক সামনে।
আসুন, সবাই
মিলে ১৫ই আগষ্টের দিন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ হওয়া বিপ্লবীদের সাথে বিপ্লবী
মদনলাল ধিংড়াকেও জানাই আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী।
তথ্যসূত্রঃ গুগল এবং উইকিপিডিয়া (হিন্দী এবং ইংরাজী)
------------------------------
রাজকুমার ঘোষ, হাওড়া
No comments:
Post a Comment