পত্রসাহিত্য -
অভিরাজের প্রতি
প্রিয় বন্ধু অভিরাজ,
কী রে কিছু মনে পড়ছে? একদিন আমি ক্লাস মিস করেছিলাম বলে তোর খাতাটা
নিয়েছিলাম।কিন্তু লাইব্রেরিতে খাতাটা তোকে ফেরত দেওয়ার আগে পাতাগুলো আনমনেই
উল্টে দেখছিলাম। হঠাৎ দেখতে পাই কভার পেজের শেষটাই লেখা 'অভিরাজ'।তোকে জিঞ্জেস করাতে তুই বলিস যে ওই নামটা তোর খুব প্রিয়।তখন
থেকে মাঝেমাঝে তোকে ওই নামে ডাকতাম।তারপর কত বছর কেটে গেল ।ওই নামে আর ডাকা হয়ে
ওঠে না। ব্যস্ত জীবনের ঘুণ পোকাগুলো জীবনের সজীবতাগুলিকেই যেন কুড়ে কুড়ে খেয়ে
ফেলেছে।আর
উপন্যাসের পাতার মতো দিনগুলোও হুড়হুড় করে কেমনভাবে কেটে
গেল বলত।এতদিন প্রয়োজনের শিকলে বন্দি হয়ে মনের আবেগ,আনন্দগুলো যেন খাঁচাই বন্দি পাখি হয়ে
রয়েছিল।মন চাইত তবু প্রয়োজন ছাড়া ফোন করা হয়ে উঠত না ।কিন্তু যুগজীবন যখন একটা
ভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত তখন হল লকডাউন।আর এই গৃহ বন্দিজীবনে আবার নতুন করে খুঁজে
পেলাম সেই পুরোনো আমিকে।এইসময় তোকে খুব মনে পড়ছিল রে, তাই চিঠি লেখা।কিন্তু তার চেয়েও বড় একটা
সত্যি আছে।মনে পড়ে, কলেজের মাঠে নরম ঘাসে বসে আড্ডা মারতে মারতে
তোকে বলেছিলাম তোকে একদিন চিঠি লিখব।তুই উদগ্রীব হয়ে বলেছিলি--"কী লিখবি?"আমি আলতো হেসে জবাব দিয়েছিলাম সে আমার
ব্যাপার।আসলে কী লিখব সেটা আমারও জানা ছিল
না।কিন্তু আজ মনটা কী কারণে জানি না বাউলের মতো উদাস হয়ে উঠল । হঠাৎ করে কাগজ বার
করে লিখতে লাগলাম। আর চিঠি লিখতে বসে তোর
প্রিয় নামটাই কেমন করে কলমের ডগাতে এসে পড়ল তে জানে।থাক বাদ দে এসব কথা ।তুই
ভালো আছিস তো? শরীর ঠিক আছে ? সাবধানে থাকিস কিন্তু ।আর সময় পেলে একবার
দেশে আসিস।রাজবাড়ি দেখতে যাব।যাব যাব করে আর যাওয়ায় হয়ে উঠেনি।মনে পরে সেই
একদিন যাব যাব করে কী বায়না।রাজবাড়ি দেখেই ছাড়ব কিন্তু ক্লাস মিস করতে তো
দুজনের কেউই রাজী নই।তাই আর--।
আরেকদিন ধরেছিলাম এমন বায়না, বলতে পারিস জেদ।কী মনে পড়ছে ?তুই একদিন কোন বন্ধুকে আমার অবর্তমানে কী
একটা খাওয়েছিলি। তাই শুনে আমার মনে মনে জেদ হল তোর যেদিন টাকা না থাকবে সেদিন তোর
কাছে খাব।আর করলামই তাই। সুযোগ বুঝে একদিন খেয়েই
খেয়ে যেতে থাকলাম ফুচকা
।তুই অবশ্য একটা বন্ধুকে ম্যানেজ করে ধার নিলি।কিন্তু আমার মায়া হল আবার
খারাপও লাগল।তাই পঞ্চাস টাকার বেশি আর খেতে পারলাম না।আমি কিন্তু ভেবেছিলাম খাওয়া
শেষে আমি ফুচকাওয়ালা কাকুকে টাকাটা দিয়ে দেব।কিন্তু তা আর হতে পারেনি।আমার বন্ধু বন্ধুর দায়িত্ব
ঠিক পালন করেছিল , ধার করে হলেও।এইরকম কত স্মৃতি যে মনে সাঁতার
কাটে বলে বোঝাতে পারব না তোকে।তোরও নিশ্চয় কাটে? মনে পড়ে লাইব্রেরিতে পড়ার ফাঁকে কিংবা কোনো
শূন্য ক্লাসের বারান্দায় বসে টিফিন ভাগ করে খাওয়া।আর যখনতখন ফুচকাওয়ালা কাকুর
কাছে সেই স্পেশাল ফুচকা খেতে ছুটে যাওয়া।মনে পড়ে একসাথে সিড়ি বেয়ে হাতে হাত
রেখে উপরে উঠা? আর আমরা দুজনে যখন দুজনের বিপক্ষে যুক্তি সাজাতে ব্যস্ত তখন স্যারেদর সেই উৎসাহ
বাণী 'এগিয়ে যাও'।মনে পড়ে কলেজে আমার সেই প্রথম আবৃত্তি পাঠ
।মঞ্চের উপর মাইকের সামনে আমি। কত কত শ্রোতা বসে রয়েছে আবৃত্তি শোনার আশায়।আমি
পাঠ করব "সাধারণ মেয়ে"।কিন্তু মনকে শান্ত করতে পারছি না।আকুল হয়ে
দুচোখ খুঁজে চলেছে তোকে ।তুই আমার রিহর্সাল শুনে প্রথম বলেছিলি "ঠিক যেন
ব্রততী"। আর কিছু কিছু ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলি"এগুলো ঠিক
করবি"।তার পর আবার রিহর্সাল করে তোকে শোনালে বলিস
"তোর আবৃত্তি
শুনে ব্রততীও যেন ম্লান মনে হয়ে গেছে।"।আমি কেমন করে সেই উৎসাহ দাতাকে না
দেখে আবৃত্তি করি বলত।কিন্তু করতে হল শেষমেষ।অত লোকের মাঝে তুই যে কোন আড়ালে
লুকিয়ে রইলি তা ঈশ্বরই জানেন।কিন্তু
আবৃত্তি করতে করতে আমার চোখ গেল থমকে।ভীড়ের মাঝে দেখতে পেলাম তোকে।উজ্জ্বল হয়ে
উঠলাম আমি। আনন্দের ঢেউ এসে ভাসাল আমাকে ।সেই আনন্দে ঝংকৃত হল আমার কন্ঠ।আবৃত্তি
করে ফেললাম--"আমি অন্তঃপুরের মেয়ে/চিনবে না আমাকে...." ।এমনি করে
হাসিখুসিতে দিন গড়িয়েছে।কিন্তু গোলাপের গায়ে কাঁটার মতো সুখের সাথেই তো জড়িয়ে
থাকে দুঃখ।একদিন আমার টাকার দরকার ,দরকার বইপত্র নোটসের।তুই সেইসময় বাড়িয়ে দিলি তোর
হাত।নিজের কষ্ট করে টিউশনি পড়ানোর টাকায় কিনে দিলি বই,জেরক্স করে দিলি নোটস।আর হাতে দিলি
প্রয়োজনমতো কিছু টাকা।অথচ তোরই তখন টাকার দরকার।টাকার অভাবে খাবি খাচ্ছে পড়াশুনা
চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। ।তবু হাসিমুখে টাকাগুলো আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললি
"রাখ এগুলো"।এইভাবেই সবসময়
হাসিখুশি রাখতিস আমায়।বলতিস "আমি এই মুখটাই সবসময় হাসি দেখতে
চাই"।এইভাবেই দেখতে দেখতে কেটে
গিয়েছিল কলেজের দিনগুলি।তারপর এতগুলো বছর।আজও মনে দোলা দেয় সেইসব রঙিন
স্মৃতি।কর্মব্যস্ত জীবন-সাঁড়াশি থেকে আলগা হয়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে সেই কলেজ
জীবনে। ঘর-সংসার আর জীবনের জটিলতাকে ঝেরে ফেলে শুনতে ইচ্ছে করে সেই প্রত্যাশা
নামটি।
ইতি--
তোর আদরের
প্রত্যাশা।
No comments:
Post a Comment