স্মৃতিচারণ -
কেমন আছিস, নাজমা?
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। গত কয়েকদিন ধরে এমনটাই হচ্ছে। আসলে
এ বিলাসিতার অবসর বোধহয় আর মন মানছে না। আবহে শিভ কুমার শর্মার সন্তুর ভাসিয়ে দিয়ে
কাজে লেগে পড়লাম। হাত দুটো কাজে মেতে থাকলেও মনের ভেতরের রঙটা হঠাৎ পুরনো ছবির মতো
হলদেটে বা সেপিয়া হয়ে গেল। আসলে কিছু কিছু গান, সুর
কোন অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়।
চারিদিকে সাজানো গোছানো জুটমিলের কোয়ার্টার। আমাদের
কোয়ার্টারের বাঁদিকে ছিল জেনারেটরের ঘর। আর সামনের কিছুটা সবুজ জমি পেরলে পর পর
দুটো কুলিং টাওয়ার। কুলিং টাওয়ারের নীচে সিমেন্টের বাঁধানো সিঁড়ির তলায় ছিল আমার
মামনির রান্নাবাটির সংসার। কখনো কখনো সোনামনি, ফুরফুরিরাও আসত। পাথর দিয়ে কচি পাতা বেটে রান্নাবান্না শুরু
হয়ে যেত। বাড়ি থেকে আটা এনে মাখামাখিও হোত। খাওয়া হোক বা না হোক কারো হাত লাল, কারো আটার আঠামাখা, কারো সবুজ - রঙের কারবার লেগেই আছে।
কুলিং টাওয়ারের পাশেই আমাদের কোয়ার্টারের নাক বরাবর নুড়ি
পাথরের লম্বা রাস্তা আর সেই রাস্তা শেষ হয়েছিল বাইরে মেইন রোডে যাওয়ার একটা বড় গেট
দিয়ে। কিন্তু সে গেট কখনো খোলা হোত না। বাইরে যাওয়ার গেট অন্যদিকে আরেকটি ছিল।
সেটাই সবাই ব্যবহার করত। কোয়ার্টারের সামনের গেটটা শুধুমাত্র মহরমের দিন খোলা হোত।
কামারহাটি থেকে ওইদিন কাজিয়া বেরত। বিশাল মিছিল, নানা
রকমের সাজানো কাজিয়া, 'হো হাসান, হায় হাসান' বলতে বলতে নিজেদের আঘাত করতে করতে এগিয়ে যেত
শত শত মানুষ। মুখে মুখে কারবালার সেই মর্মান্তিক ঘটনা মুখস্ত হয়ে গেছিল সেই সময়।
এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা সেই সময় প্রকট ছিল না। সবাই সবার অনুষ্ঠান
দেখতাম।
ওই গেটের পাশেই ছিল একটা ছোট্ট ঘর একফালি বারান্দা নিয়ে।
সবসময় বন্ধই থাকত। হঠাৎ একদিন দেখি একটি আমার বয়সী মেয়ে সেই বারান্দায় বসে।
প্রায়দিনই দেখতাম তাকে। সে অবশ্য আমাদের মতো ফ্রক পরে না। সুতীর জংলা প্রিন্টের
সালোয়ার কামিজ, মাথায় সুতীর ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে চাদরের মতো
করে গায়ে জড়ানো। কৌতূহল আটকাতে না পেরে একদিন পৌঁছে গেলাম তার কাছে। নাজমা। নাজমা
হিন্দিতে কথা বলে। কোয়ার্টারে নানা ভাষাভাষীর লোকজন থাকায় খুব ছোট থেকেই পারতাম
হিন্দিতে কথা বলতে। আমাদের দোতলাতেই থাকতেন বালসারা আন্টি। পার্শী ফ্যামিলি। জন্মে
থেকেই দেখাশোনা। নাজমাও খুব খুশি আমায়
পেয়ে। বাবার কাছে শুনলাম আব্দুল্লাহ কাকু মিলের ওয়ার্কার। রাজস্থান থেকে এসেছেন।
এই মূহুর্তে ওয়ার্কার কোয়ার্টার কোথাও ফাঁকা নেই তাই ওখানে অস্থায়ী বাস। আবদুল্লাহ
কাকু শুধু নাজমাকেই নিয়ে এসেছেন। নজমার মা, বাকি ভাইবোন সব দেশে আছে। নাজমা আমার অবাক হওয়ার শুরু।
স্টোভে মাঝারি সাইজের হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে নাজমা আমার সঙ্গে খেলা করত। সত্যিকারের
আগুন, সত্যিকারের ভাত, তরকারি হচ্ছে নাজমার ছোট্ট ছোট্ট হাতে -
বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে ওর রান্নার গন্ধে খুব বলতে ইচ্ছে হোত 'আমায় দুটো তোর রান্না করা ভাত দিবি মেখে?'
লজ্জা পেতাম, বলিনি কখনো। গরমের ছুটিতে সকালেই খেলতে যাব
বলে নাজমা ভোরে উঠে রান্না সেরে ফেলত। মা আমার ঘুম ভাঙাত,
'নাজমার রান্না হয়ে গেল, উঠে পড়ে নে তাড়াতাড়ি। '
এমনই এক ভোরে চোখ মেলে দেখলাম বাবা মা পাশে কেউ নেই। কেউ
আমায় ডাকেওনি। জানলা দিয়ে দেখলাম নাজমাদের ছোট্ট কোয়ার্টার থেকে কুন্ডলী পাকানো
কালো ধোঁয়া বেরচ্ছে। প্রচুর লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। কে যেন চিৎকার করে বলছে,
’নাজমার নাভি পুড়ে গেছে।'
তার কয়েক বছর পরেই বাবা চব্বিশ বছরের চাকরি ছেড়ে অন্য
জায়গায় ট্রান্সফার নেন। মনে আছে মা খুব কান্নাকাটি করেছিলেন এত পুরনো জায়গা ছেড়ে
যেতে। কিন্তু আমি যেন আরাম পেয়েছিলাম। নাজমার হাওয়াই চটিস ফটাস ফটাস শব্দ পাটের
সোনালী চুলে উড়ে বেড়াত কোয়ার্টার কম্পাউন্ডে। তারপরেও অনেক খেলেছি বন্ধুদের সঙ্গে, কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই আমায় নাজমা তাড়া করে
বেড়াত। বাবাকে দেখতাম অন্ধকার ঘরে রেডিও চালিয়ে অঝোরে কাঁদতে। সন্তুর বাজত
রেডিওতে। আব্দুল্লাহ কাকু এসে বলতেন আমাদের গাঁওতে ওর চেয়েও ছোট মেয়েরা গৃহস্তি
সামলায়। ভাবলাম ওকে নিয়ে যায় আমার সঙ্গে, ওখানে থাকলে তো বিয়ে দিয়ে দেবে। এখানে আপনাদের বাচ্চাদের
সঙ্গে বড়ো হোক। সেই বিয়ে হয়ে ছাই হয়ে গেল সাহাব।
জুটমিল এখন সব বন্ধ। বাবাও চলে গেছেন অনেকদিন। তবু ইচ্ছে
করল একবার ঘুরে আসি বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে। চারিদিকে বড় বড় লতানো গাছের জঙ্গল।
অধিকাংশ কোয়ার্টারের জানলা দরজা ভাঙা। চিনতেই পারলাম না নিজের মেয়েবেলাকে।
কুশলসংবাদ
****
আজ পা রাখলাম বহুযুগ পর
কেমন আছ সকাল ছটার ভোঁপু বাঁশি?
ফ্যাক্টরি তে সবুজ বিপ্লব ঘটানো শ্রমিকের দল?
কেমন আছ?
সোনালী পাটের বুকচেরা সুতো,
ভাল আছ তো?
শ্রমিকের নিঃশ্বাসে ধুলো দিয়ে
বিদেশে পাড়ি জমাও আর
হপ্তার টাকায় নাজমার ফটাস ফটাস
হাওয়াই চটির ঔদ্ধত্য
কেমন আছ? কেমন আছে নাজমা?
একফালি ঘরে ভাত ফোটা গন্ধ
আর ঘুমন্ত নাজমা কালো ধোঁয়া হয়ে মিশে যাওয়া
আমার মৃত্যু দেখা প্রথম দুপুর?
আব্বুর সারা গায়ে সোনা সোনা চুল আর নাজমার শেষটুকু
পুকুর পাড়ে নুড়ি পাথর আর সবুজ পাতায় কুটনো কাটা রান্নাঘর
আমাদের
নাজমা এখনো ঘুমায় আর ভাতের গন্ধ আসে
কেমন আছিস?
ফ্যাক্টরির বুক জ্বলা কালো ধোঁয়া নাজমার সাথে আকাশে মেশে
জনৈক শ্রমিক চীৎকার ছুঁড়ে দেয়
নাভি পুড়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment