স্মৃতিচারণ -
এক বরযাত্রীর অভিজ্ঞতা
কত বছর হবে। চার দশক অর্থাৎ 40 বছরের আগের কথা। ভাবলে
আজও শরীর মন শিউরে ওঠে। ঘটনার আকস্মিকতা আজও আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।বিয়ের বরযাত্রী
অনেকেই যায়। আমিও গিয়েছিলাম ৷ মাত্র দুই বন্ধু,বরকর্তা, কোল বর এবং পুরোহিত। আমাদের
গন্তব্য স্থান বর্ধমানের শ্রীগ্রাম। জীবনের প্রথম বরযাত্রী।ফলে দারুণ উত্তেজনা। জঙ্গিপুর
রোড স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল দুপুর দেড়টা নাগাদ। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুর। বয়েস কুড়ির
আশেপাশে। বন্ধু না এলেও বন্ধুর দাদার বিয়েতে বরযাত্রী বৃদ্ধ পুরোহিত সমেত বিকেল চারটার
সময় সালার স্টেশনে ট্রেন থেকে গরমে ঘেমে নেয়ে উঠেছি। ট্রেন থেকে নেমেই টিফিনের ব্যবস্থা
হল। দুজন লোক আমাদের আহ্বান করে কিছুটা হেঁটে দুটো গরুর গাড়ি দেখিয়ে বললেন এই গাড়িতেই শ্রীগ্রাম যেতে হবে। থ্রিল রোমাঞ্চ জেগে
উঠলো। শহরের ছেলে, গরুর গাড়ি চাপার অভিজ্ঞতা হবে। পরে জেনেছি দুজনেই দুটি গাড়ির গাড়োয়ান।
চেপে বসলাম। দুলকি চালে এগিয়ে চলেছি। ক্রমে বিকেলের আলো নিভে সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। ঘন্টা
খানেক চলার পর ক্লান্তি বিরক্তি একসঙ্গে গ্রাস
করলো আমাদের। বরের গাড়ি আগে, আমরা পিছনের গাড়িতে। দুটি গাড়ির দূরত্ব বাড়ছে। সালার ছাড়িয়ে
গ্রামের পথে চলেছি।দ্বিতীয় ঘন্টা পার হবার পর গায়ের ব্যথা অনুভব করছি। পুরোহিত মশায়
ধৈর্য্য হারিয়েছেন শুনতে পাচ্ছি। গ্রামের রাস্তায় আলো নেই। আকাশের তারার আলোয় ভরসা
করে চলেছি।খাবার জল শেষ। হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেলাম।আমাদের সামনের গাড়ির গাড়োয়ানকে নিয়ে
উত্তেজনা।ভুল রাস্তায় চলতে গিয়ে কবরের রাস্তায় উঠে গেছে। তাকে তো এই মারে কি সেই মারে।
পুরোহিত মশায় সমাধান করেন হাতে পায়ে ধরে।দুশ্চিন্তা উদ্বেগ বিরক্তি হতাশা আমাদের গ্রাস
করেছে।শুরু হল অন্ধকারে পথচলা। তৃতীয় ঘন্টায় উদ্বেগ আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে। গাড়োয়ান পথ ঠিক
করতে পারছে না। বুড়ো পুরোহিত ভয় পেয়েছেন বুঝতে পারছি। আমরা তিন বন্ধু ঝিমিয়ে পড়েছি।
ভগবানকে ডাকছি। রোমান্স থ্রিল সব হাওয়া আমাদের। ভালোয় ভালোয় বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম দরকার। হাহুতাশ করছি।হঠাৎ গাড়োয়ানের চিৎকার , ওই
দূরে বিয়ে বাড়ির লোক হ্যারিকেন নিয়ে আমাদের জানান দিচ্ছে। ধরে প্রাণ এলো ।হাঁফ ছেড়ে
বাঁচলাম। গাড়ি বলদ সহ এগিয়ে চলেছি। প্রায় ঘন্টা তিনেক মোট সময় লাগলো বিয়ে বাড়ি পৌঁছতে।
গ্রাম নিঝুম।নিঃশব্দ চারিদিকে। অজ পাড়া গ্রাম। একটা হ্যাচাক। উলুধনি শুনতে পেলাম না।গরুরগাড়ি
থেকে নেমে ক্লান্ত আমাদের কন্যা পক্ষ নিয়ে গেল পাশের উঁচু গোয়াল ঘরে।একজন হ্যারিকেন
নিয়ে খড় পাতা শতরঞ্জির উপর থাকতে দিলেন। খিদেয় পেট চু চু করছে। ছাদনাতলার পাশে কোনো
রকমে মাটিতে ঠান্ডা জলখাবার এবং রাতের খাবার খেয়ে বিয়ে না দেখে ঘুমিয়ে পড়ব ঠিক করলাম
তিনবন্ধু। বিয়েবাড়ি নাকি অন্য কোথাও এসেছি মালুম হচ্ছে না। হৈ চৈ নেই। কি ব্যাপার
! সব চুপ চাপ। জানতে পারলাম, বিয়ে বাড়িতে এই সব গ্রামে ডাকাতি হয় বলে রাতে আনন্দের ব্যবস্থা নেই। যাই হোক,
খেয়ে বিশ্রাম
নিচ্ছি, হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেলাম দূরে ডাকাতি করতে আসছে মশাল নিয়ে। কনে পক্ষের লোকজন
আমাদের সহায়তা চাইছেন। খালি টিন বা কানেস্তারা বাজাতে হবে, তাহলে ডাকাতদল পালাবে।
তখন আমাদের
অবস্থা আধমরা। বুড়ো পুরোহিত ছাদনাতলায় কি করছে জানি না।দূর থেকে মশালের আলো দেখালেন
কন্যা পক্ষের একজন। বাঁচার তাগিদে আমরা টিন বাজাচ্ছি। ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় ডাকাতি
হলো না। পালাতে পারলে বাঁচি।অথচ কিছু চিনি না।বর্ধমানের শুরু মুর্শিদাবাদের শেষ। অন্য
দিকে বীরভূম। মনে হল এখানেই ভবলীলা শেষ। ভাবছি কি কুক্ষনে বরযাত্রী হতে রাজি হলাম।এরই মাঝে দেশি মদ খেয়ে এক মাতাল চিৎকার
করছে। বর কানে কম শুনতে পায় এবং আগে একবার বিয়ে হয়েছিল ।বউকে মেরে তাড়িয়েছে। এসব শুনে
মাথায় হাত। রাত শেষ হতে চললো।ভোরের আলো ফুটতে বাকি নেই ।পালানোর পথ বন্ধ। আবার গোরুর গাড়িতে ফিরতে হবে ভাবতেই পা কাঁপছে। আমরা বন্ধুর
দাদার এত কীর্তির কিছুই জানি না। তখন বুঝলাম কেন বরযাত্রী আসতে কেউ রাজী হয়নি। ভোর
হতেই গরুর গাড়ী এসে হাজির। প্রাণ নিয়ে সেদিন আবার ট্রেনে চেপে বাড়ী ফিরতে ফিরতে দুপুর
গড়িয়ে বিকেল। এক বর্ণ বাড়িয়ে লিখিনি। হয়ত কিছু কম হয়ে গেল। মধ্য ষাট বছরে এসে পুরোনো
সেদিনের কথা ভাবলে শরীর মন উদাস হয়ে যায়।এই স্মৃতি ভুলবো না।
No comments:
Post a Comment