স্মৃতিচারণ -
পুরানো সেই দিনের কথা...
ক্যালেন্ডার বলছে সবে গ্রীষ্ম। আমাদের লাইমসিটির বচ্ছরভোর
মুখ ভার করা আকাশের কালো, ধুসর, সীসারঙা, ধোঁওয়া ধোঁওয়া রঙা, ইত্যাদি মেঘগুলো বুঝিবা,এই অজানা অতিমারীর ভয়েই
ঘরে ফিরে অবেলায় দোর দিয়েছে।এতদিন
ধরে ওদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঝকঝকে নীল আকাশটার মত কেমন ফাঁকা লাগছে আমার এই
অনৈচ্ছিক গৃহবন্দী দিনগুলো। এটাই তো আদর্শ সময় নিজেকে নিজের পুরানোদিনের গল্প
শোনানোর। না না মনখারাপের গল্প নয়।ভালো লাগার গল্প। আমার ফেলে আসা দিনের গল্প।
পুরোনো দিনের গল্প বলতে আমি নিজের আকার আয়তন নিয়ে কিছু বলছি
না, ৪৫ থেকে বেড়েচেড়ে ১০০ কেজি হওয়ার গল্প কোন
ভদ্রমহিলা প্রকাশ্যে ডিস্কাস করে নাকি? আরে ছি:।তারপর ধর একদা যে চুলে মাকে চিরুণী চালাতে দিতাম না
বলে মাথার থেকে বেশি পিঠের ওপরই সে চিরশত্তুরের অনায়াস বিচরণভুমি ছিল আজ সে প্রায়
কচ্ছের রণ,কিম্বা সেই কবে মায়ের চশমাটি আয়নার সামনে
দাঁড়ালেই নিজেকে স্রেফ সোফিয়া লোরেন দেখতাম বলে ভাগ্যদেবী ক্লাস এইট থেকে নিজের
জন্য গোটা একটা চশমা বরাদ্দ করে দিলেন, এখন চাইলেও সে প্রাণের বন্ধুনীকে ছাড়তে পারব না, অথবা, ছোটবেলায় যে বাংলা হাতের লেখা (বা একটু বড়বেলায় এসে রচনা)
লিখতে বললে চোখের জলে নাকের জলে যে আমি সিমেন্টের মেঝেতেও অকাল বান আনতাম (
ইনক্লুডিং মায়ের হাতের জম্পেশ প্রতিষেধক)
সে আমি আজকাল দিনের পর দিন বাড়ির লোক ছাড়া বাংলা বলতে না পাড়ার শোকে রাগে
ম্যাগাজিনের পাতায়, খবরের কাগজে পারলে ঘরের দেওয়ালে আঁকিবুকি
কাটি, এ জাতীয় নাকের ডগা
লাল,হাতের তালু নীল হয়ে যাওয়া দুক্ষু মোটেও করছি
না বাপু, তাহলে কি বলছি? এক দুই করেই লিখে ফেলি তাহলে।
১. ছোটবেলা থেকে অসম্ভব নাটক আর যাত্রা শোনার নেশা
ছিল।রবিবারের বোরোলিনের সংসার থেকে শনিরারের হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্সের শনিবারের
বারবেলা, বা পিথ্রির বিদেশি থ্রিলারের বাংলা
রহস্যকাহিনী, রবি শনির দুপুরের নাটক, শুক্রবারের রাত আটটার নাটক, বুধবার সন্ধ্যার যাত্রা,মঙ্গলবার দুপুরের শ্রুতিনাটক এসব শোনার
পারমিশন দিতে মা কম ব্ল্যাকমেল করতে আমায়! তার আগে এতটা হোমটাস্ক করে দেখাতে হবে, আলমারীতে নিজের তাক গোছাতে হবে, বইয়ের র্যাক সাফ করতে হবে, মলাট দিতে হবে,নিজের জুতো সাফা রাখতে হবে,উফফফফফ।
লালকমল নীলকমলের জন্য ক্লাশ ওয়ানে এন্যুয়াল পরীক্ষায় অংক
খাতার একপাতায় কুচি কুচি হাতের লেখায় সব অংক কষে খাতা জমা দিতে গেছিলাম।ছায়া
দিদিমণি খাতা জমা তো নেনই নি উলটে ধমকে বলেছিলেন খাতা চেক করতে, যেই দিদিমনি একটু বেরিয়েছেন ক্লাস থেকে আমিও
খাতা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে নীচু পাঁচিল টপকে সোজা বাড়ি। আমার মা আবার ত্রিকালজ্ঞ কিনা, রেডিও উঠে গেল হাতের নাগালের বাইরে,আমার পিঠেই লালনীল নকশা।এখন টিভি দেখতেও ভালো
লাগেনা,সিনেমা তো হলে গিয়ে লাস্ট দেখেছি বছর বিশেক
আগে,নাটক তাও অবরেসবরে সুযোগ পেলে দেখি, মোদ্দা কথা, নেশাটা আর নেই।
২. পড়াশুনো
জিনিসটায় আমার চিরকালের আপত্তি..সেই শ্লেটে খড়ি বুলিয়ে অ আ লিখতে গিয়ে কতবার যে
চোখের জলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে শ্লেট মুছেছি সে খবর একা আমিই জানি..তারপর সেই ক্লাস
ওয়ানের পরীক্ষায় লালকমল নীলকমলের টানে স্কুল পালানো তো বললামই,তবে সেবার আরেকটি কীর্তি করেছিলাম ..বাংলা
পরীক্ষায় আমার পাড়ার যে সহখেলুড়ে বাবলির সাথে স্কুল যেতাম সে কিচ্ছু লিখতে পারছিল
দেখে অন্যান্যদিন ক্লাসে যা করতাম, সেরকমই পুরো খাতাটাই ওকে দিয়ে চুপ করে বসেছিলাম...আমার তখন
লেখা শেষ তো...অণিমা দিদিমনি দেখতে পেয়ে কি বকাটাই দিয়েছিলেন..তারপর যতটা বাবলি
কপি করেছিল ততটা দুজনের খাতা থেকে কেটে দিয়ে খাতা জমা নিয়ে নিলেন..জীবনের প্রথম
স্কুলের পরীক্ষায় ফোর্থ হয়েছিলাম...তখন মানে বুঝিনি...কিন্ত গল্পের বইয়ের নেশাটা
মা ঐ বয়সেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাই স্কুলের এনুয়াল ফাংশানে ফার্স্ট সেকেণ্ড থার্ড
যারা হয়েছিল তারা প্রাইজের বই হাতে স্টেজ থেকে নেমে এল আর আমি কিচছুটি পেলাম না
এটা খুব মনে দাগা দিয়েছিল..মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম এবার থেকে আমাকেও স্টেজে উঠে
বই নিতে হবে....ক্লাস টুয়েলভ অবধি সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারতাম না যদি না আমার মায়ের
মত শক্তপোক্ত এবং নিজের হাতের মাসলের ওপর অটুট বিশ্বাস রাখা মহিলার হাতে না
পড়তাম....উউফফ...তবে জনান্তিকে বলি, মা না থাকলে.আমার স্কুলে ভালো রেজাল্টও হত না...গল্প কবিতার
চর্চাও হত না( আমার মা অসাধারণ কবিতা লেখেন কিন্তু ছাপাতে দেন না)... মাধ্যমিকের
আগে অসীমাদির 40 রকম ফোঁড়ের নমুনা কি উলের
টুপি মোজা বেবিকোট সোয়েটার...পুরো হাতে সেলাই করা প্রমান মাপের ব্লাউজ সায়া বানানো
হতনা...ওগুলো মায়ের হাতের কাজ..আমি পুতুলমাপেরটা হাতে বানিয়ে কাজচালানো গোছের
শিখেই রেহাই পেতাম... তবে কুরুশকাঁটায় বুনতে খুব ভালোবাসতাম...কম সময়ে অনেকটা বোনা
যায়....ডিজাইনতোলা সোজা....আমার মত ফাঁকিবাজদের জন্য আদর্শ...
এখন একমাত্র পড়া আর লেখার কাজটাই দেখলাম পারি, তাই করিও, আমার বাবার মত মুক্তাক্ষরে লিখতে না পারার শোকে কম্পিউটারেই
লেখালেখির কাজ সারি....পেনপেন্সিলের সাথে আপাতত "নো সম্পর্কতা" , মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর দুটো চাইনিজ
পেন পেয়েছিলাম...একটা কাকা দিয়েছিলেন আরেকটা ছোড়দা মানে আমার মামা....দুজনের কেউই
আজ নেই কিন্তু পেনদুটো আছে....ভালো কন্ডিশনেই আছে....তবে কিনা সেলাই টেলাই ভুলে
গেছি....সদ্যজাত বোনঝির সোয়েটার টুপি
কুরুশে বুনতে বুনতে রাউরকেলা থেকে
হাওড়া পৌঁছে সেই যে কুরুশটা কোথায় রাখলাম না, আর বুনিনি .....
৩. ছোটবেলা থেকে ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেট কি বলতে গেলে
ইলেক্ট্রিক্যাল ইকুইপমেন্টসের ওপর আমার এক অপ্রতিরোধ্য নেশা ছিল। খুব কম বয়স থেকে
ঘরের ফিউজ পাল্টানো, বালব বা টিউব চেঞ্জ, দেওয়ালির আগে জানলায় টুনিবালবের মালা ঝোলানো
এই ধরনের টুকটাক কাজগুলো বাবার সাথে করতে করতে নিজেই পরের দিকে একা করে নিতাম।
কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান পড়ে রেডিও সারানো শিখে ঘরের একমোবদ্বিতীয়িম মার্ফিটার ওপর কত
যে সার্জারি বা হাতমশকো করেছি তার সাক্ষী আমি আর মা, রেডিওটা আজ নেই কিবা তাই সাক্ষ্য দিতে আসতে
পারবে না। বাবার টুলস বক্স ঘাঁটতে কি যে ভালো লাগতো, স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাস, কাটার, তুরপুন, সল্ডারিং, স্প্যানার,হ্যাক-স,ফাইল,নাট বল্টু,রঙিন তার, রেঞ্জ,আহা কি সুন্দর খেলনার জগত! এখন তারা আছেন কিন্তু
যন্তরমন্তরে বন্দীদশায়, আজকাল তাদের সাথে আমার আর কোন "সম্পর্কতা"
নেই।এখন এ সব কাজে বাঁধাধরা ইলেকট্রিশিয়ান আসেন।
৪..বৃষ্টিতে ভেজা ছিল আমার একসময়ের তুমুল আনন্দ। ছোটবেলায়
বিকালে খেলতে গেলে কি স্কুল থেকে ফেরার সময় যখন আকাশ কালো করে কালবৈশাখী আসত, আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটায় গায়ের লোম দেখতে
পেতাম না তখন আনন্দের চোটে নাচতে ইচ্ছে করত।দুদিকে হাত ছড়িয়ে গোল গোল হয়ে ঘুরতাম
যতক্ষন না মাথা ঘুরত।আর বৃষ্টি? সে রহস্য না বলাই ভালো।
"বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
ও সে কোন অপরূপ সৃষ্টি
এত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি।।"
প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় বৃষ্টিবাদলার দিনে কে সি পালের
লাল নীল হলুদ সবুজ ছাতাটা মাথা ঢাকার কাজে যত না লাগত তার চেয়ে বেশি ওটা উলটো করে
বৃষ্টির জল ভরার কাজে লাগাতাম বেশি। জামাকাপড় বইপত্র ভিজে চুপ্পুড়, তাতে কি? ঘরে ফিরে আড়ং ধোলাই মায়ের হাতে, কারণ ওই জামাকাপড় বইপত্র শুকিয়ে পরের দিন
স্কুল পাঠানোর ঝামেলাটা বোঝার বুদ্ধি তো তখন ছিল না,তা বলে যদি কেউ ভেবে থাকেন ওতেই আমার বেগ
থামতো, তাহলে আপনি ১০০% নয় ১০০০% ভুল মশাই! পিঠে এক দুরাউন্ড ড্রাম
পিটানোর রিস্ক নিয়েও পরের দিন, না হলে, তার পরের বা তার পরের পরের দিনে সেই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
মোহিনীমিলের সামনে থেকে পুরো ভার্নার লেনে তখন হাঁটুর ওপর নোংরা ড্রেনের জল, তাতে জুতো খুলে খালিপায়ে হাঁটার এমনই মজা যে
বর্ষাকালে রেনিডে হলে রাগ হত।পরে চাঁদনী চালিয়াত ইত্যাদি সিনেমা দেখে টেখে নিজেকে
আর ভিজেশ্রী উপাধিধারী ভাবতে ইচ্ছে তো হতইনা..উল্টে লজ্জা লাগত..।অতএব বৃষ্টি
ভেজায় ইতি।এম্নিতে এখনো আমি বাবা স্বল্পবুদ্ধির লোক।অনেক কিছুই মাথায় ঢোকেনা।
এখন ঝড়বৃষ্টি তাই জানলা দিয়েই দেখি, ছোটবেলার কথা মনে পড়ে বই কি, আজ যেমন পড়ছে।এখন বৃষ্টির জলে গাড়ি আটকালে
রাগই হয়, কর্পোরেশন এর গুষ্টি উদ্ধার করি।বিভিন্ন
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার বৃষ্টির জলের কম্পোজিশন নিয়ে পেপার লিখি, পড়ি। ছোটবেলার মানিকজোড় দোসর বৃষ্টি এখন আমার
পাশের পাড়ার সই।
যতবার ফিরে যাব আমার পুরোনোদিনের গল্পে, ততবার এই চেনা মুখগুলোই ঘিরে ধরবে আমায়, ততবার এই বলে শেষ না হওয়া গল্পেরাই আমায়
ছুঁয়ে থাকবে পরম ভরোসায়।এ এক অনিঃশেষ রূপকথা আমার।
ভালো থাকুন সবাই। সুস্থ থাকুন, সাবধানে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। বর্তমানের হাসিকান্না, সুখদুঃখের সাথে অতীতের অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যতের
স্বপ্নকেও সঙ্গে রাখুন বরাবরের মত। ধন্যবাদ সব্বাইকে।
No comments:
Post a Comment