স্মৃতিচারণ-
অচেনা গলি
এই ফুচকাওয়ালা, আট আনায় কটা ফুচকা? চারটে । চারটে ফুচকার
আশ্বাস পেয়েই সুশীলকে বললাম আমার কাছে আট আনা আছে, তাহলে তুই খেয়ে নে । সুশীল নেহাতই
সুশীল বালকের মতো আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আর তুই? আমি স্মিত হেসে বললাম, তুই খেলেই আমার
শান্তি । তুই এখন খা, আমি পরে খেয়ে নেবো । আমার কথামতো সুশীল খাওয়া শুরু করতেই আমি
পেছন থেকে পালিয়ে যাই । সোজা এক দৌড়ে ঘরে ।
এটা নিতান্তই ছোট বয়সের একটা অন্যতম দুষ্টুমি । তখন ভাবনার
বয়স ছিলোনা যে সুশীলের পকেটে পয়সা আছে কিনা? ফুচকাওয়ালাকে পয়সা না দিলে ওর কি শাস্তি
হতে পারে ? দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করলেই সেই সময় এইরকম হাজারো উদ্ভট দুষ্টুমি মাথায় আসতো
আর করে ফেলতাম অনায়াসেই ।
আগে পিছে পরিণামের কথা চিন্তা করার না তো ছিল বয়স, না ছিল
সেভাবে চিন্তাধারা । শুধু বদবুদ্ধির ইচ্ছেটাই ছিল আসল রসদ।
আট আনা মানে তখন আমাদের কাছে ছিল মহার্ঘ্য । মাসে দুমাসে
কোন এক বিশেষ তিথি নক্ষত্রের মিলন ঘটলে এরকম আটআনা কখনও সখনও নবাবী করার জন্য জুটে
যেত মায়ের মাধ্যমে । বাবার কাছে চার আনা আট আনা চাইলে তার খরচের ফিরিস্তি দিতে দিতেই
মনে হতো এর থেকে না চাওয়াই হয়তো ভালো । তার মানে এই নয় যে তিনি কৃপণ ছিলেন, আসলে জবাবদিহির
মাধ্যমে ছিল একটা সুশৃঙ্খল অনুশাসন । আমার বাইরে থেকে কেনা কোন রঙিন জিনিষ সে আইসক্রিম
হোক বা চকলেট — কোনটারই অনুমতি ছিলনা । তাই চার আনা যদি চাইতাম আইসক্রিম খাওয়ার জন্য,
সেটাও তাঁকে দেখিয়েই খেতে হতো ।
যত দিন গড়িয়েছে, তত দিন বদলও হয়েছে । এখন হয়তো আট আনা চার
আনায় কোন কাজ হয়না, কিন্তু কি অকাতরেই না বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের হাতে কাড়িকাড়ি
টাকা দিচ্ছেন পকেটমানি হিসাবে । ফলস্বরূপ এই জেনারেশনের বহু ছেলে মেয়ে নেশাগ্রস্তও
হচ্ছে । এমন নয় যে তাদের বাবা মায়ের শাসন নেই, কিন্তু কোথাও যেন বজ্র আঁটুনি ফস্কা
গেরোর মত অবস্থা । পরোক্ষ শাসন করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ শাসনে সামান্য হলেও গলদ থেকে যাচ্ছে
।
যাই হোক, অন্যের কথা চিন্তা না করে নিজেদের কথা বলাই ভালো
। আসলে আমাদের ছোটবেলাটা ছোট ছোট দুষ্টুমির মধ্যে দিয়ে কাটলেও তার আভিজাত্য আলাদা ছিল
। ছোট বেলায় আমাদের কাছে দুটি মন্ত্র ছিল, এক লেখাপড়া আর দুই খেলাধুলো । লেখাপড়ার পর
সারাটা সময় শুধু খেলা ছাড়া অন্য কোন চিন্তা আমাদের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারত না । কোন
দূর দূর পাড়ায় গিয়ে খেলে আসতাম । আর রবিবার মানে ছিলো নিখাদ খেলার দিন । এইদিন সারাদিন
বইপত্রের পাট চুকিয়ে শুধু খেলা আর খেলা ।
এই খেলা নিয়েও একটা মজার ঘটনা আছে আমার । এখানেও মূল পাত্র
সেই সুশীল । সেদিন সকালে একটু আগেই আমরা দু তিনজন মাঠে পৌঁছে গেছিলাম । কেউ একটা বাড়ীর
নোংরার সাথে একটা বাঁধাকপি ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছিলো । আমি ঠিক করলাম এটা কাউকে দিতে
হবে । বদবুদ্ধি যখন কাজ করে তখন ভালো মন্দের বিচার থাকেনা । আমারও ছিলনা । কাউকে কিছু
না জানিয়ে সুশীলদের বাড়ীতে দিয়ে এলাম । কাকীমাকে বললাম সুশীল পাঠিয়েছে । এরপর খুব সাধারণ
ভাবেই খেলা শেষে যে যার ঘরে ফিরে গেলাম । প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো বাঁধাকপির আলোচনা
কিন্তু খেলার ছলে ততক্ষণে সুশীলের কানেও চলে গিয়েছে । আমি ছাড়া কেউ জানত না ওটার সদগতি
কোথায় হয়েছিল । এরপর আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা । দুপুরে খেতে বসে সুশীল জানতে পারে
সেদিনকার উপাদেয় বাঁধাকপিটা আমিই তার নাম করে তার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম । ঘরশুদ্ধ সবাই
বমি করে আমার ঘরে উপস্থিত আর আমার পিঠে আমার দাদার লাঠি ভাঙা আজও স্মৃতির মণিকোঠরে
জাজ্জ্বল্যমান ।
এরকম প্রচুর কথা আছে, কথাদের ভিড়ে আর দীর্ঘায়িত করব না
স্মৃতিচারণ । জানি স্মৃতি সততই সুখের হয়, তবুও কিছু স্মৃতি তুলে রাখা ভালো আগামীর জন্য
। কিছু স্মৃতি অল্প হলেও গল্পচ্ছলে বলে রাখাও ভালো ।মনে পড়ে প্রথম রক্তদান, তাও আবার
বয়স লুকিয়ে মাত্র সতেরো বছর বয়সে । এক অচেনা আগন্তুকের কষ্টে এগিয়ে যাওয়া ভয়হীন চোখে,
কিম্বা পরবর্তীকালে একটা আস্ত রক্তদান সমিতির পরিচালক হিসাবেই । দিন নেই, রাত নেই কোথায়
না ঘুরেছি । পেয়েছি চেনা অচেনা মানুষের সস্নেহ সান্নিধ্য । সে সময় পাড়ার বাজে ছেলে
থেকে ধীরে ধীরে ভালো ছেলে হয়ে ওঠার গর্বও ছিল । একই সাথে সম্ভবত প্রথম ভ্যালেন্টাইন
ক্লাব গড়েছিলাম আমারই নেতৃত্বে । সালটা সম্ভবত ১৯৯৮-৯৯ হবে ।
এখনও নিজের এলাকা, পুরনো পাড়া দিয়ে গেলে মনে পড়ে অলিগলিগুলো
। যদিও আজ তার অনেকাংশই বহুতল আবাসনের কবলে । চেনা ছক ভেঙে নতুন নতুন ইমারতের ভিড়ে
হারিয়ে গেছে ছোটবেলার অনেককিছুই । যেভাবে হারিয়ে গেছে পেয়ারা, বাতাপি , বেল, আম, জামের
গাছগুলো । যেভাবে হারিয়ে গেছে ছোটবেলার ডাংগুলি, চাকা ঘোরানো, সাতঘুটি, কানামাছি,কাবাডি,
চু কিৎকিৎ থেকে ক্রিকেট,ক্যারামেরা । আজ কর্মব্যস্ত জীবনে এখনও যদি দেখি কোথাও খেলছে
ছেলেমেয়েরা, সেখানে দাঁড়িয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি । ইস! আবার যদি ফিরে পেতাম আমার ছোটবেলার
অলিগলি।
No comments:
Post a Comment