গল্প -
তৃপ্তি
সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার, ৮ই জানুয়ারি, ১৯৮৫ – বেশ ঠাণ্ডা সেদিন। কলকাতা থেকে একটু দূরে বিবেকানন্দ পল্লীতে
দুপুর থেকেই বাস, ট্যাক্সি আর গাড়ির ভিড়। নতুন এক বছরের শুরু, ক্লাস সিক্স থেকে টেনের প্রায় ছশো ছেলে ঐদিন
ফিরল সারদা বিদ্যাপীঠে – যে যার নতুন ক্লাসে উঠেছে। ওদের সাথে এল আরও
একশো কুড়ি জন নবাগত, ক্লাস ফাইভের। বেশিরভাগেরই চোখ ছলছল, একটু পরেই তাদের পৌঁছে দিয়ে বাবা-মা চলে
যাবে। যাওয়ার সময় এগিয়ে আসতেই অনেকেরই হাউ হাউ করে কান্না, চোখের জল বাধা মানছে না – যেন তারা আর কোনদিন বাবা-মা কে দেখতে পাবে
না। বাবা মাথায় পিঠে হাত বোলাচ্ছে, মা হামিতে হামিতে ভরিয়ে দিচ্ছে – ছেলের চোখে জলের ঢেউ তাতে আরও উথলে উঠছে!
হোস্টেলের তিনতলাতে ৫ নম্বর ব্লকের একদম শেষে ২৮ নম্বর ঘর ।
একটা ছেলে ঢুকল তার বাবার হাত ধরে। চারজনের থাকার জন্যে নির্দিষ্ট সেই ঘরে তখন
বাকিরা সবাই চলে এসেছে – বাকিরা বলতে একজন সিনিয়র, ক্লাস সিক্সের আর ক্লাস ফাইভের নতুন অন্য
দুজন । ক্লাস সিক্সে ওঠা ছেলেটা পুরনো, তার অভিভাবক চলে গেছে – সে এখন দু’জন রুমমেট আর তাদের বাবা-মাদের আশ্বাস দিচ্ছে যে চিন্তার
কোন কারণ নেই! সে সব বলে দেবে কখন কি করতে হবে। সে আবার এই হস্টেলের তিনজন শিক্ষার্থী পরিষদের একজন – হোস্টেল সুপার অখিলেশদার পরেই এরা
তিনজন!
- তোমরা তাহলে
মনিটর?
- না, না কাকু; আমাদের ওপর এই হোস্টেলের এই সব ব্যাপারের দায়িত্ব। এস পি বা
শিক্ষার্থী পরিষদ প্রত্যেকটা আবাসেই থাকে, দু’মাস পর পর পালা বদলায়, আবার
অন্য তিনজন আসে।
- তাহলে দু’মাস পরে তোমার বদলে অন্য কেউ এস পি হয়ে
যাবে...
ক্লাস সিক্সের অশেষ রক্ষিত একটু দমে গেল এটা শুনে। এমন সময়
রুমে ঢুকল অত্যন্ত কালো একটা ছেলে – চোখে মোটা কাঁচের চশমা; সাথে ওর বাবা। তাঁর মাথায় ছেলের বেডিং আর একটা টিনের সস্তা
বাক্স, অন্যদের মতন ট্রাঙ্ক বা সুটকেস নয়। ওনার ধুতি
পাঞ্জাবি আর গায়ে জড়ানো শালের রঙ কোনো এককালে হয়তো সাদা ছিল – প্রচুর ব্যবহারে আর রাস্তার ধুলোতে এখন আর
ওগুলোকে সাদা বলা যায় না । ওরা ঘরে ঢুকতে আলোচনায় বাধা পড়ল। সবাই ওদের দেখতেই
ব্যস্ত হয়ে উঠল কিছুক্ষণ। এদের পোশাক আর
চলার ধরণ বেশ অন্যরকম, যাকে এখানে ছেলেরা বলে গাঁইয়া!
- এখানে রাখুন
কাকু, এটাই খালি আছে।
ঘরটা প্রায় দশ বাই দশ, একদিকে তিনটে জানলা; জানলাগুলোর ঠিক সামনে একটা করে তক্তাপোশ পাতা – যাকে এখানে বেড বলে, চারটে পায়া ছাড়া তক্তাপোশের একদিকে একটা
বাক্স আছে – যাকে বলে বেডবক্স। অশেষ মাঝের জানালার সামনের
বেডটা দেখাল। ওর নিজের বেড ঘরের অন্যদিকে, দরজার ঠিক পাশে।
- তোমার নাম কি? অশেষ নতুন ছেলেটাকে জিগ্যেস করল।
- আজ্ঞে, আমার নাম সুতনু ঘোষ।
- আর আমার নাম
রতন ঘোষ, আজ্ঞে!
ঘরের সবার চোখে মুখেই একটু মজা খেলে গেল যেন...
- জানলা খুলবেন
না কাকু! একটু অন্ধকার হলেই প্রচুর মশা ঢুকে পড়বে।
রতন বাবু একটু থতমত হয়ে এবার অন্যদের তুলনায় অনেক রোগা একটা
বেডিং খুলে পাততে লাগলেন।
- ওর বেডবক্সে
এটা কার জুতো? অশেষ সুতনুর বেডের দিকে দেখিয়ে রুমের বাকি
অন্যদের দিকে তাকাল।
- আসলে আমার
বাবাইয়ের এতগুলো জুতো ওর নিজেরটাতে ধরছে না! প্রিন্স চৌধুরীর মা সাথে সাথে উত্তর
দিলেন।
- আমাদের স্কুল
শু ছাড়া, পিটির কেডস আর চটি দরকার। এর বেশি দরকার নেই।
জায়গা না হলে প্রিন্সকে ওর বেডের তলাতেই রাখতে হবে কিন্তু।
প্রিন্সের বাবা সাথে সাথে হোস্টেলের থার্ড এসপির কথা তামিল
করলেন। ইনিই একটু আগে অশেষের পদটাকে গুলিয়ে ফেলছিলেন মনিটরের সাথে। ঘরের চতুর্থ জন
শুভাশিস লাহিড়ীর বাবা-মাও সাথে সাথে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন নিজের ছেলের
জিনিসপত্রের দিকে, সেগুলোও যাতে না অন্য কারোর জায়গা দখল করে
বসে।
- সুতনু এই
সিংগল ডেস্কটা নিতে পারে।
অশেষ ওর বেডের আর শুভাশিসের বেডের মাঝে একটা টেবিলওলা
আলমারি দেখাল। এর ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে পরপর তিনটে আলমারি। তাতে বাকি তিনজনের
জিনিসপত্র আগেই ঢুকে গেছে।
- চল, এবার যাওয়া যাক। প্রিন্সের বাবা ওর মাকে
ইশারা করলেন।
- হ্যাঁ, ওদের সংসার এবার ওদের নিজেদেরই বুঝে নিতে
দিন। শুভাশিসের মা ওর বাবার থেকে বেশি বাস্তববাদী। চশমা পরা সুশ্রী ভদ্রমহিলার ছোট
চুল আর কথাবার্তায় একটা ইন্দিরা গান্ধীমার্কা ভাব।
টিনের ট্রাঙ্ক থেকে সুতনুর সামান্য যা জিনিস বেরোল – তাতে ওর আলমারির একটা তাকই ভরল না। বাকি বাবা
মায়েরা সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে অন্তত একটা করে ব্যাগ বা সুটকেস নিয়ে ফেরত গেল। রতন
বাবুর ফেরত নিয়ে যাবার কিছু নেই। এরই মধ্যে একটা ঘণ্টা বাজল কিছুটা দূরে... রতন
বাবুর দিকে ফিরে অশেষ বলল,
- কাকু এবার
আমাদের হেভি টিফিনের বেল পড়ল। ও কি কিছু খাবে? আপনারা তো অনেক দূর থেকে আসছেন।
- আজ্ঞে, ঠিক বলেছ বাবা; আমরা আসছি মেদনিপুরের ওদলচুয়া গ্রাম থেকে; ঝাড়গ্রাম থেকে ভেতরে অনেকটা যেতে হয়! কিরে
খিদে হইছে?
- না; ইস্টিশানে অনেক ভাত খেয়ে নেছি।
সুতনু ঘর প্রায় ফাঁকা দেখে উত্তর দিল। প্রিন্স আর শুভাশিস
গেছে হোস্টেলের গেট অব্দি, বাবা মা চলে গেলে ফিরে আসবে।
- আর বেশিক্ষণ
সময় পাবেন না কিন্তু, এরপর প্রেয়ার বেল পড়বে, প্রার্থনা ঘরে যেতে হবে ধুতি পরে।
- ও জানে কি করি
পরতি হয় ধুতি! রতনবাবু এক গাল হাসলেন।
সেদিন রাতে ডাইনিং হলে প্রায় আশি জন ছাত্র প্রথমবার একসাথে
হল। মাথা গুনে দেখা হল, নিজের নাম, ক্লাস আর কোথায় বাড়ি বলতে হল সবাইকে। তারপর
একটা বেদমন্ত্র পড়ে খাওয়া শুরু হল। মোটা চালের ভাত, ডাল, ফুলকপির তরকারী আর সবশেষে ডিমের ঝোল। অনেকের জন্যে একসাথে
রান্না, খাবারের স্বাদ কিছু নেই, সবাই কোনও রকমে খেল, কেউ বা পাতেও কিছু অভুক্ত রেখে খাওয়া শেষ করলো অন্য আরেকটা
মন্ত্র পড়ে। শুভাশিস দেখল ওর পাশে বসা সুতনু কিন্তু বেশ তৃপ্তি করেই চেটেপুটে খেল
সবকিছু।
আসলে এতগুলো পদের রান্না সুতনু শেষ খেয়েছে বছর দুয়েক আগে; মা ওর জন্মদিনে করেছিল। ওকে তাতান বলে ডাকতো
মা। জন্মদিনের কয়েকমাস পরে এক বর্ষার বিকেলে ও তখন মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছিল
বাইরে। মা ওকে দু’বার ডাকল, বলল ভেতরে আসতে – নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ও প্রায় সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে
দেখেছিল মা খুব কাশছে, আর সেই কাশির সঙ্গে মুখ দিয়ে ফোয়ারার মত রক্ত
ছুটছে। গ্রামের ডাক্তার বছর খানেক আগেই মাকে দেখে বলেছিলেন যে ওর মায়ের যক্ষ্মা
হয়েছে। পুরোপুরি সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে। শরীরের যত্ন, ভালো খাবারদাবারের প্রয়োজন। এরপর কিছুদিন
ওষুধ খাওয়াতে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিল ওর মা। সচেতনতার অভাবে বুঝতে পারেনি যে
এরকম সময়ে যক্ষ্মার ওষুধ বন্ধ করাটা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। গরিবের সংসার, ঠিকমত পথ্যও জোগাতে পারেনি ওর বাবা। সেদিন ওষুধ নিয়ে বাবার সঙ্গে তাতান যখন বাড়িতে
ফিরে এল মা ততক্ষণে পাড়ি দিয়েছে চিরকালের না-থাকার অচিন দেশে।
No comments:
Post a Comment