বিতর্ক -
স্মৃতি সততই সুখের (বিপক্ষে)
একজন মানুষ নিজের জীবনে অন্যের যা সহজেই বহন করে নিয়ে যেতে
পারে তা স্মৃতি। স্মৃতির স্মরণী বেয়ে একের হৃদয়ে স্থায়ী হয় অন্যের অস্তিত্ব। তাকে
ঘিরে থাকা সুখ দুঃখের সমাবেশ এক অনাবিল অনুভূতির স্পর্শ জাগায় অন্তরে। তবে নিজের
মধ্যে কেবলমাত্র অন্যের অস্তিত্বের পুনরায়
জাগরণই স্মৃতির পরিসর নয়। মানুষের
নিজের পূর্ব জীবনের ফেলে আসা ছোট ছোট মুহূর্ত, বহুমূল্য সময়, আনন্দ-উল্লাস, প্রিয়জনের সান্নিধ্য এমনকী আরও বহু বিষয়
স্মৃতি রূপে স্থায়িত্ব অর্জন করে তার মধ্যে। যার অনুধাবন অনেক সময় স্পর্শ করে যায়
আমাদের ব্যাথাতুর মন, স্নেহকাতর অনুভব, হৃদয়বিগলিত প্রেমাকাঙ্ক্ষা। স্মৃতির অভিনব
প্রকাশ সুখের আবেশে জীবনকে ভরিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু সেই সুখস্মৃতির উপস্থিতি
চিরস্থায়ী নয়। তাই স্মৃতি সতত আমাদের মধ্যে সুখের স্পর্শ জাগাতে অসমর্থ। সোজাসুজি
ভাবে স্মৃতি বলতে বোঝায় 'যা মনে রাখা হয়' অর্থ্যাৎ সাধারণত পূর্বের কোনও বিষয়। যাকে
ফেলে আসা বিষয়ও বলা যেতে পারে। আবার ফেলে আসা অনেক কিছুই হারিয়ে যাওয়ার সামিল--যার
স্মরণ মানব হৃদয়ে কখনই সুখের সঞ্চার করতে পারে না।
বস্তুত 'স্মৃতি'- এই শব্দের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে, এক ধরনের অদর্শণীয় এবং অস্পর্শনীয় এক অনুভূতি, যা আপনার মধ্যে আপনিই অস্বচ্ছ। প্রিয়
আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রিয় আকাঙ্ক্ষিত--যে কোনও ক্ষেত্রেই অপ্রাপ্তির স্মৃতি সর্বদাই
বেদনাদায়ক। স্মৃতি অনেকক্ষেত্রে আমাদের অন্তরের তৃষ্ণা বর্ধিত করে অন্তরেই তাকে
নির্জীব করে তোলে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন--
"স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?"
আবার সময়ান্তরে বিলুপ্ত হয়ে স্মৃতি বিস্মৃতির আবেদনে আরও
বেদনাঘন মুহূর্ত গড়ে তোলে।
স্মৃতিতে যেমন
সুখের বিস্তার, তেমনি বিস্তার দুঃখের। তাইতো প্রাপ্তির
স্মৃতি যেমন আনন্দে আল্লাদিত হয়ে ওঠে, আবার তেমনি হারানোর ব্যাথায় আকুল হয়ে ওঠে। স্মৃতির স্মরণীতে
আসে নির্জীব অস্তিত্বের জন্য হাহাকার, অতৃপ্তির হতাশা এবং অপ্রাপ্তিজনিত দীর্ঘশ্বাস। আনন্দের
পাশাপাশি স্মৃতির পাতায় দ্বিগুণ ভাবে জমে ওঠে বিষাদমাখা বেদনাবিধুর দিনগুলির কথা।
শুধুমাত্র একজনের ব্যক্তিজীবনেই নয়, তার দেশ, জাতি, রাষ্ট্রের লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, নির্মমতার ইতিহাস তার বর্তমান পরিসরকেও করে তোলে অশ্রুকাতর।
স্মৃতির পাতায় জমা
হয়ে থাকে কারও জীবনের দুর্বিষহ কোন অভিজ্ঞতার বা নিষ্ঠুর কোনও অবমাননার কাহিনি।
স্মৃতিসজাগ এই জীবন কাহিনির সঙ্গে মানুষ যুগ যুগ ধরে সম্পৃক্ত। দেশীয় প্রেক্ষাপটে
ঘটে যাওয়া বহু দুর্জয় যুদ্ধ-বিগ্রহের করাল সন্ত্রাসের ছায়া স্মৃতি রূপে মানবজীবনে
আতঙ্কের প্রতিরূপ হয়ে দেখা দেয়। বিগত পুলওয়ামা কান্ডের নির্মম স্মৃতি কখনই সুখের
আস্বাদ দিতে পারে না। এক হতাশায় আচ্ছন্ন করে আমাদের মন-- কারণ স্মৃতি যে
অসংশোধিতও। বারে বারে দুরবস্থার স্মরণে মানুষের জীবনকে তিক্ততায় আবিষ্ট করে দেয়।
তবে মেঘ কেটে গিয়ে আসা নতুন আলোর মতোই মানবজীবনের ক্ষণিকের সুখও উঠে আসে স্মৃতির
খাতায়। যার স্মরণ অবশ্যই মধুর, তবু ক্ষণিক। কারণ সুখ-দুঃখ পূর্ণ কোনও মানুষের জীবনেই সুখ বা দুঃখের কোনটিরই একাধিপত্য থাকতে পারে
না। তাই সুখ যেমন কাম্য, দুঃখও তেমনি বাস্তব। আর তাই মানবজীবন
সম্পৃক্ত স্মৃতিও সতত সুখময় নয়।
No comments:
Post a Comment