পত্রসাহিত্য -
মাধবীলতার প্রতি
মাধবীলতা,
তখন সবে একুশ। সদ্য কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে পা রেখেছি।
সর্বাঙ্গে একটা আলাদা অনুরণন। একটা আলাদা কিছু করার তাগিদ সমস্ত দেহ মনে ঢেউ তুলে
যায়। ইউনিভার্সিটির গেট থেকে বেরিয়ে কলেজষ্ট্রীটের রাস্তায় পা ফেলে সোজা কফি হাউস, সেখান থেকে আবার হাঁটতে শিয়ালদহ – প্রতিটি পদে মনে হত তোমার পায়ে আমি পা
মিলাচ্ছি। প্রেমে পড়লাম তোমার, মাধবীলতা। অনিমেষ যে আমারই এক সত্তা। অনিমেষ আর আমি একই
সাথে পথ চলি, পথ ভাঙি। পার্থক্য শুধু অনিমেষ যে রাজনীতির
সাথে জড়িয়ে পড়েছিল, আমি সেই রাজনীতির উত্তাপ পাইনি, সেই উত্তাপ কে শুধু বাইরে থেকে অনুধাবন
করেছিমাত্র। কারণ, সেই আগুনের উত্তাপ তখন নিভে গেছে। সেই আগুনের
ব্যপ্তি আর গভীরতা নিয়ে কেবল চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে তখন। যেমন চলে আর কি। আমি সেই
সময়ের, সেই সময়কালের প্রতিটি নিঃশ্বাসকে প্রাণভরে
অনুভব করেছি। বিশ্বাস কর , অনিমেষ আর আমার মধ্যে আলাদা কোনও সত্তা নেই।
শুধু সময় আর রাজনীতির প্রেক্ষাপট টা আলাদা।
তুমি তো জানো মাধবীলতা। শুরুটা হয়েছিল এক বিষণ্ণ বিকেলে।
আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ভারি মেঘের দল । আর অনিমেষ কলকাতার হোস্টেলের জানালা দিয়ে
বাইরে তাকিয়ে ডুবে আছে নস্টালজিয়ায়। যখন সে প্রথম এই শহরে এসেছিলো, তারপর সেই যে প্রথমদিন মুখোমুখি হলো এক
দুর্ঘটনার, উরুতে একটা গভীর দাগ ফেলে গেল এক দুর্ঘটনা!
পড়াশোনার একটা বছরও তো বাদ দিতে হলো সেজন্যই। তারপরই তো অনিমেষের রাজনীতিতে আসা।
সে আর সময়ের দাবীকে উপেক্ষা করতে পারলনা। ঠিক এসময়েই তো তুমি অনিমেষের মুখোমুখি
হলে। মনে আছে মাধবীলতা! কেমন একটা আড়চোখা চাহনিতে যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিল তোমাদের।
তোমার সেই আড়চোখা বড় বড় চোখগুলো অনিমেষকে ভীষণই টানত। তুমি জানতে সেটা। সেই
জানাটাই তো একদিন প্রেমের এক দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে গেল তোমাদের। কোনও
প্রপোজাল ছাড়াই দুজন দুজনকে বুঝে ফেললে তোমরা। প্রতিটি সাক্ষাতে তোমারা খুঁজে পেতে
উড়ে বেড়ানোর এক স্বপ্নীল তাগিদ। লাইব্রেরি, বসন্ত কেবিন, কলেজ স্ট্রীট, শিয়ালদহ, কফি হাউস- সর্বত্র, সর্বত্র তোমরা উড়ে বেড়াতে। কিন্তু তুমি তো জানতে অনিমেষ উড়ে
বেড়ানোর ছেলে নয়। তার ভেতরে জন্ম নিয়েছে যে সময়ের আগুন, সে আগুন তাকে ধিকি ধিকি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে
তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে অবিরত। তুমি তো
চিনেছিলে অনিমেষের শেকড়টাকে, আর নীরবে মেলতে দিচ্ছিলে তার ডালাপালাগুলোকেও।
মনে আছে তোমার, অনিমেষ তখন দ্বিধায় জর্জরিত। তথাকথিত
কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসেছে সে। দলের মতাদর্শের সাথে আর একমত হতে পারছে
না। আর সে সময়েই তার সাথে সাক্ষাৎ হল
কম্যুনিস্ট বিপ্লবী সংগঠন অল ইন্ডিয়া কো অর্ডিনেশন কমিটির। এই কো অর্ডিনেশনে যারা
ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই প্রাক্তন কম্যুনিস্ট নেতা।
তাদের সবার, সবার সাথেই কখনো না কখনো মতভেদ হয়েছে মূল
অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির। তারপর তাঁরা নতুন দল তৈরি করল। চা শ্রমিক, গ্রামের মানুষ, কৃষক, মজুর - সবার সাথে শহুরে লোকেদের একটা সংযোগ ঘটাতে চাইছিলেন
তাঁরা। আবার অনিমেষ দ্বিধায় ভোগতে শুরু করল। একদিকে সে রাজনীতি ছাড়তে চায়, আবার
অন্যদিকে সে নিজেকে এদের একজন বলেও মনে করে। তারপর তো অনিমেষের জীবনটাই পাল্টে
গেল। নক্সাল রাজনীতির সাথে ক্রমে জড়িয়ে পড়ল সে। ধীরে ধীরে সেও বিশ্বাস করতে শুরু
করল বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু সেই মুহূর্তেও তুমি অনিমেষকে ছেড়ে
যাওনি। তার সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যত জেনেও। তুমি তাঁকে একবারও তো ফিরে আসতে
বলোনি। তুমি কি পারতেনা অনিমেষকে ফিরিয়ে আনতে!
তোমার সৃষ্টিকর্তা (সমরেশ মজুমাদার) তোমাকে নিয়ে লিখেছেন,
“মাধবীলতা কোনও রাজনীতি করেনি কখনো, শুধু তাকে (অনিমেষকে) ভালোবেসে আলোকস্তম্ভের
মতো একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খরতপ্ত
মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল জলের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায়না। বাংলাদেশের এই মেয়ে যে
কিনা শুধু ধূপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকাকালকে সুন্দর করতে”। আবার তিনিই তোমাকে নিয়ে লিখেছেন,
“দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিষ্ফল হতাশায় ডুবে
যেতে যেতে অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা”।
বিশ্বাস করো মাধবীলতা, আমি বুঝতে পারিনা এই দুটি সত্তা তোমার মধ্যে কী করে মিলে
মিশে একাকার হয়ে গেল! হ্যা, তোমাকে নিয়ে যদি একবার ভাবি - তোমার মধ্যে
সেই বাঙালী মেয়েরই প্রকাশ দেখতে পাব। চুলগুলো বেনি করা, হাতে সস্তা কাচের চুড়ি, কপালে লাল টিপ, লম্বা স্লিভের ব্লাউজ, ঘাড়ে সাদামাটা একটা ভ্যানিট ব্যাগ, পরনে মাড় দেওয়া একটা সস্তা শাড়ী, পায়ের সেন্ডেলটাও অযত্নে পরায় পায়ের অঙ্গুলি
উকি দেয়।
তবে যে সেই তুমিই অনিমেষের সাথে আলোচনা করেছ, তর্ক করেছ – কম্যুনিজম নিয়ে, কম্যুনিজমের মত গভীর একটা বিষয় নিয়ে! তুমিই তো অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করেছ ‘তুমি কী নিজেকে কম্যুনিস্ট মনে কর?’
আমেরিকা ভিয়েতনাম আক্রমন করেছে। আর সেই তুমিই
তো অনিমেষের সাথে আলোচনা করেছ ভিয়েতনামের সেই যুদ্ধ নিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজে বসে তর্ক করেছ এখানে
মিছিল করলে ভিয়েতনাম বাসীদের আদৌ কোনও উপকার হবে কিনা। সেই তুমিই তো কম্যুনিস্টদের
কাছে জানতে চেয়েছ যে, আপনারা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথদের প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে করেন
কেন? তাহলে কে বলবে তুমি রাজনীতি সচেতন নও! তুমি কেবল বাংলাদেশের
সেই মেয়ে যে কিনা শুধু ধূপের মত নিজেকে পোড়ায় আগামীকাকালকে সুন্দর করতে! তুমি কি
পেরেছিলে নিজেকে পুড়িয়ে আগামীকালকে সুন্দর করতে, সুন্দর করে গড়ে তুলতে! না। এই প্রশ্নে অযথা
তোমাকে বিব্রত করবনা মাধবীলতা। তুমিই তো পেরেছিলে তোমার আত্মজ অর্কের মধ্য দিয়ে
সমাজ বদলের অন্য আর এক আদর্শের বীজ বপন করে দিতে।
আসলে তুমি সেই মেয়ে মাধবী - যেখানে বিপ্লব ও প্রেম মিলেমিশে
এক হয়ে যায়। কে যেন বলেছিলেন বিপ্লবীকে আগে প্রেমিক হতে হয়। তুমি সরাসরি হয়তো
রাজনীতি করোনি, রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়নি। তবে তুমি কী
অনিমেষকে সমর্থন করোনি। পুলিশ হন্যে হয়ে যখন অনিমেষকে খুঁজছে। আর অনিমেষ পুলিশের
হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তুমি শান্তিনিকেতনে গোপন জায়গায় দেখা
করতে গিয়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করলে অনিমেষের কাছে। অনিমেষের শরীরে নিজের শরীরকে
সঁপে দিলে। সেই প্রথম। হ্যা মাধবী, সেই প্রথম তোমার আর অনিমেষের রক্ত মিলেমিশে এক হয়ে গেল।
তোমার পেটে জন্ম নিল তোমার আত্মজ, অর্ক। সেকি কেবলই সময়ের সামান্য ভুল, আবেগ! নাকি অনিমেষের প্রতি তীব্র ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার সাথে যতটা আবেগ ছিল, ঠিক ততটাই কী তার রাজনীতির প্রতি মৌন সমর্থন
ছিলনা! কিংবা ধরো, অনিমেষ যখন জেলে। পুলিশ পশুর মতো মেরে মেরে
অনিমেষের হাত পা গুলোকে ভেঙ্গে দিয়েছে। তখনো কি তুমি তাকে স্বান্তনা দিয়ে যাওনি!
তাকে বলোনি “তুমি তো কখনো তোমার আদর্শ থেকে একটুও নড়নি’। এই সান্ত্বনা, এই সমর্থন, এই ভালোবাসা, একজন আপাদমস্তক রাজনিতিকের রাজনৈতিক আদর্শকে
পেটে বহন করে নিয়ে বেড়ানোর মধ্যে কী কোনও রজনীতি ছিলনা মাধবীলতা!
আসলে মাধবীলতা, তুমি বিপ্লবেরও আরেক নাম। সেই বিপ্লব শুধু রাজনীতির চেনা
ছকের মধ্যেই বাঁধা পড়ে থাকেনি। তা এতকালের চেনা জীবন, চেনা সমাজ, চেনা রাজনীতি, চেনা আদর্শ আর রীতি নীতির সমস্ত ছককে দুমড়ে
মুচড়ে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। তুমি রাজনীতি
করতে না, তুমি অনিমেষের মতো রাস্তায় নেমে পড়নি, কিন্তু তুমি কখন কোন অজান্তেই অনিমেষের নিবিড়
ছায়ার সাথে বড় হতে হতে তুমিও রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলে- যা তুমি তোমার জীবনে, জীবনের ইস্পাত-কঠিন দিনগুলিতে তোমাকে পথ
দেখিয়েছে। তাইতো সত্তরের সেই উত্তাল দিন গুলিতে মধ্যবিত্তের চেনা ছকের বাইরে
বেরিয়ে এসে মাথা উঁচু করে ‘সমাজ বহির্ভূত প্রেমের’ এক ‘অবৈধ সন্তান’কে পেটে বহন করতে পেরেছিলে। তাকে জন্মও দিয়েছিলে তুমি।
সামাজিক বিয়ের দরকার হয়নি তোমাদের, তবু তুমি হয়ে উঠেছিলে মাধবীলতা মিত্র। তৎকালীন সমাজ পরিবেশে
জীবনের এই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা – তাকে বিপ্লব বলব নাতো কী বলব মাধবীলতা! কিংবা ধরো, সব হারিয়ে অনিমেষ জেল খেটে পঙ্গু অবস্থায় বের
হল, পুলিশ মেরে তার হাত পা গুলোকে পঙ্গু করে
দিয়েছে, সে হাঁটতে পর্যন্ত পারছে না, অনিমেষের চেনা বন্ধু, রাজনৈতিক নেতারা তখনন কে কোথায়, কারও কোনও খবর নেই - তখন তুমিই তো তাকে পরম আদরে যত্নকরে নিজের এক
চিলতে ঘরে আশ্রয় দিলে। যার সাথে কোনও সামাজিক বিয়ে হয়নি, তাকে ঘরে তুলে নিতে সামান্য কুণ্ঠাবোধ হলনা
তোমার। অতবড় ছেলে অর্ককে পরম মমতায় অনিমেষের হাতে তুলে দিলে ইচ্ছেমতো ছেলেকে গড়ে
তোলার জন্য – তখন তোমাকে যে আর আমার এই ছোট্ট মধ্যবিত্ত মন
নিয়ে আর মাপতে পারিনা মাধবিলতা! তখন তুমি সকল সামাজিক, রাজনৈতিক বন্ধন আর নীতি আদর্শের অনেক দূরে এক
অমলিন ধূপকাঠির শিখা হয়ে দাঁড়িয়ে থাক – এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই নীতি, এই আদর্শ তোমাকে তখন স্পর্শ করার সাহস পর্যন্ত আর রাখতে
পারেনা মাধবীলতা।
আর তাইতো তোমাকে
আজও ভালবাসি মাধবী। আজ এই ক্রান্তিকালে সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুও যখন শুষে নেই কোনও
এক বিষণ্ণ বিকেল, জীবনের গভীর অন্ধকারের মাঝে পথ হারিয়ে ফেলি, সময়ের ফেনিল আবর্তে সকালের দিগন্তরেখাটাও যখন
আর দেখা যায়না, তখন তোমাকেই যে আঁকড়ে ধরে থাকি মাধবীলতা। আজ
তোমাকে আমার খুব খুব দরকার মাধবী। বিশ্বাস কর। খুব, খুব দরকার।
ইতি
তোমার অপেক্ষায় আমি, আমি
তোমারই একজন ।
No comments:
Post a Comment