নিবন্ধ -
কলকাতা ছিল সেই 'কলকাতাতেই'
কলকাতা! নামটা শুনলেই কলকাতাইয়ান্স বা কলকাতাবাসীর মনে
কেমন একটা পুলক জেগে ওঠে। শুধু কলকাতাবাসী নয়। প্রবাসী কলকাতার মানুষের মনেও ভেসে
ওঠে একের পর এক চিত্রকল্প। ভিক্টোরিয়া, ময়দান, হাওড়া ব্রিজ, শ্যামবাজারের মোড়ে নেতাজির ঘোড়ায় চড়া মূর্তি, গথিক স্থাপত্যের রাজভবন, চিড়িয়াখানার গেট, বইমেলা, কলেজ স্ট্রিট, হলুদ ট্যাক্সি, কফিহাউজ.... বলে শেষ হয় না। আচ্ছা, কলকাতা না হয়ে যদি অন্য কোনো নাম হত, তাহলেও কি এতটাই প্রেম থাকত তাকে ঘিরে? কেন কলকাতাই নাম হল? জানতে হলে সফর করতে হবে ইতিহাসের
প্রত্নপ্রাচীন গন্ধওয়ালা পাতাগুলোয়। মনের সময়-যন্ত্রের "রিওয়াইন্ড"
বোতাম চাপলে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে 'কলিকাতা'কে।
পঞ্চম শতকের
বিপ্রদাসের "মনসামঙ্গল" এ কলিকাতা বা কলকাতার কথা প্রথম পাওয়া যায়।
এছাড়াও মুকুন্দরামের "চন্ডীমঙ্গল" আর মহান সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরের
আত্মজীবনী "আইন-ই-আকবরী" তে পাই কলকাতার কথা।
বর্তমান কলকাতার গোড়াপত্তনকারী হিসেবে জোব চার্নকের নাম
পাওয়া গেলেও, চার্নক সাহেব কেবল সুতানুটীকেই কলকাতা হিসেবে
ভাবতন। তাই তিনি কলকাতার আবিস্কারক, একথা ইতিহাস প্রমাণিত মিথ্যা। তাই কোলকাতার আদিকথা জানতে
হলে ফিরে যেতে হবে সেই ষোড়শ শতাব্দীতে।
বাংলাদেশে ব্যাবসা করতে আসা জাত-বনিক ইংরেজরা নিজেদের
ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের জন্য জমি কিনতে উদ্যত হল। সেসময় দিল্লির গদিতে
ঔরঙ্গজেবের পৌত্র শেহনশাহ আজিম উশ-শান।
১৬৯৮ সনে তাঁর থেকে অনুমতি মিলল গোবিন্দপুর, সুতানুটী ও কলিকাতা গ্রাম তিনটি কেনার। সেসময়ের জমিদার
চৌধুরীদের থেকে মাত্র তেরো হাজার টাকার বিনিময়ে তিনটে গ্রাম কিনল কোম্পানি। যদিও
কোম্পানির অ্যাকাউন্টের খাতার হিসেবে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা, কারন শেহনশাহের অনুমতি পত্র ক্রয় করতে দিতে
হয়েছিল ষোলো হাজার টাকার উপঢৌকন।
সেই আমলের সরকারি হিসেবে কলকাতায় মোট বাসযোগ্য জমির পরিমাণ
ছিল ৮৪০ বিঘা। তার মধ্যে ২০৪ বিঘায় ছিল ঘরবাড়ি। আর ৪০০ বিঘা জমিতে ছিল একটি 'গ্রেট বাজার'। যার বর্তমান নাম বড়বাজার। এছাড়াও মন্দির, গির্জা, মসজিদ এবং কোম্পানির খাসজমি ছিল বিস্তর।
এহেন কলিকাতা বা
আজকের কলকাতা তখন ছিল তিনটি গ্রাম নিয়ে। গোবিন্দপুর,সুতানুটী এবং কলিকাতা (পূর্বে উল্লেখিত)।
মিথ্যে এবং মিথ মিশিয়ে এই তিন গ্রামের নামের কারণ নিয়ে কানাঘুষো অনেক
তত্ত্বই হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়।
যেমন গোবিন্দপুরের কথাই ধরা যাক। কেউ বলেন এ গাঁয়ের
আদিপুরুষ গোবিন্দ দত্ত। তিনি ছিলেন রাজা বসন্ত রায়ের কর্মচারী। ইষ্টদেব
গোবিন্দজীর থেকে স্বপ্নাদেশ পেলেন- মাটি খুঁড়লে টাকা পাওয়া যাবে। সেইমত
কালীঘাটের নিকট এক মনোমত জায়গায় মাটি খুঁড়ে পেলেন প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা। তখন
গোবিন্দজীর নামে পত্তন করলেন গোবিন্দপুর গ্রাম।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বংশধরদের মতে তাদের গৃহদেবতা
গোবিন্দদেবের নামেই গোবিন্দপুর গ্রাম।
আবার হাটখোলার দত্ত এবং কুমোরটুলির মিত্র দের দাবি তাদের
পূর্বপুরুষ গোবিন্দবাবুই গোবিন্দপুরের পত্তন করেন।
সুতানুটী গ্রামের নাম নিয়ে রয়েছে দুটি প্রধান তত্ত্ব। কেউ
বলেন- সুতা এবং নটী(নর্তকী, অভিনেত্রী)-র ব্যবসায় প্রসিদ্ধ হওয়ায় গ্রামের নাম
সুতানটী বা সুতানুটী।
দ্বিতীয় মতে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে জায়গীরদার মানসিংহ বড়িশার জনৈক
বাঙালি লক্ষ্মীকান্ত চৌধুরীকে কলিকাতা জায়গীর হিসেবে দেন। ইনি ছিলেন বিখ্যাত
জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীর পূর্বসূরি। এদের দেবতা শ্যামরায়ের মন্দিরের সামনে ছিল এক
বিশাল ছত্র বা ছাতা, যার নীচে প্রতিদিন পুজোর পরে প্রসাদ লুট হতো।
এ থেকেই ছত্রলুট এবং মানুষের মুখে মুখে বিবর্তিত হয়ে হয়ে ধ্বনি-বিপর্যয়ের
ফলস্বরূপ আজকের সুতানুটী।
এরকম কলিকাতা বা ক্যালকাটা কিংবা কলকাতাকে নিয়েও রয়েছে
অজস্র জনশ্রুতি এবং তত্ত্ব।
যেমন কেউ কেউ বলবে 'কালী' দেবীর নাম থেকেই নাম কলকাতা। অর্থাৎ, কালী+থা= কোলকাথা>কোলকাত্তা>কলকাতা। একসময় অধুনা বেহালা থেকে
দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত ছিল কালীক্ষেত্র। আর অধীশ্বরী ছিলেন কালীমাতা।কাপালিকরা তাকে
তুলে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করল কালীঘাটের জঙ্গলে। নাম হল কলকাতা।
অপর এক মতে ইংরেজ স্থাপিত কিলা বা কেল্লা থেকে কলকাতা
এসেছে। তবে এই মত সর্বতভাবে গ্রহনযোগ্য নয়।
আরেক দল বলেন- কলি বা চুন আর কাতা বা ভাটি থেকে কলকাতা বা
চুনের ভাটি। একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর জেলে বা ধীবর থাকত। শামুক, ঝিনুকের খোল পুড়িয়ে চুন তৈরি করার জন্য
বিখ্যাত ছিল এ জায়গা। তা থেকেই নাম কলিকাতা বা কলকাতা।
ডাচ ভাষাভাষী বা ওই ভাষার বিশেষজ্ঞরা বলছেন- গলগাথা থেকে
কলকাতা। গল অর্থ মড়ার খুলি। সেই থেকে গলগাথা অর্থাৎ মড়ার খুলি বোঝাই দেশ। একসময়
কলকাতা অঞ্চলে ছিল গহন জঙ্গল, সেখানে ছিল ঠগ বা ঠ্যাঙাড়েদের আড্ডা। তারা পথচলতি নিরীহ
মানুষকে হত্যা করে তাদের সর্বস্ব লুটে নিত। দুর্ভাগা মানুষের দেহটা পড়ে থাকত
জঙ্গলে। প্রকৃতির নিয়মে দেহের মাংস পচে গিয়ে শুধু হাড়গোড় পড়ে থাকত।
আবার "খালকাটা" ক্যালকাটা বা কলকাতা নামের কারণ
হিসেবে জানা যায়। বর্গীদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে
এক গভীর পরীখা বা খাল কাটা হয় কলকাতা নগর কে(কারন তখনও শহর হয়ে ওঠেনি)
ঘিরে। ঐতিহাসিক পরিভাষায় যাকে চিনি "মারাঠা ডিচ" নামে। তবে এ ধারণা
অমূলক এবং ভিত্তিহীন। কারন ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলিকাতা নামের উপর
সরকারী সিলমোহর পড়ে। আর মারাঠা আক্রমণ হয় তার প্রায় সাড়ে তিন যুগ (৪২ বছর)পরে।
কলকাতা বা ক্যালকাটা নিয়ে এক মজাদার চুটকি বা 'জোক' এর কথা সেসময়ে জানা যায়। একবার এক ফিরিঙ্গি এক ঘাসুড়ে
ঘাস কাটতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করে এটা কোন জায়গা? ঘাসুড়ে ভাবে সাহেব হয়তো জানতে চাইছে-
ঘাসগুলো কবে কাটা? সে জবাব দিলো - কাল কাটা। সেই সুত্রেই
ক্যালকাটা বা কলকাতা।
এরপর আসা যায় সর্বশেষ এবং ইতিহাস সমর্থিত মতামতে। কালিকট
বন্দরের নামে আজকের কলকাতার নাম। ঠিকই, "কালিকট"। দক্ষিণ উপকূলের বন্দর কালিকটে
প্রথম ভিড়েছিল পোর্তুগিজ জাহাজ। ইউরোপের বাজারে প্রথম ভারত তথা কালিকটের জিনিস
নিয়ে যায় পোর্তুগিজেরা। দামে সস্তা এবং গুণমানে উৎকৃষ্ট হওয়ায় দ্রুত জনপ্রিয়
হল এসব জিনিসপত্র। এদিকে জাত-ব্যাবসাদার ইংরেজরা পড়ল মহা ফাঁপরে। অনেক চেষ্টা
করেও কালিকট বন্দরের হদিস মিলছে না। উল্টে তারা এসে পড়েছেন কলিকাতা গ্রামে।
কিন্তু কোথায় কালিকট! কোথায় কলিকাতা! কে কিনবে ইউরোপে কলিকাতার জিনিস! মাথায়
হাত ব্যাবসায়ীদের। সেসময় পরিত্রাতা হলেন ইংরেজ জাহাজের এক বুদ্ধিমান ইংরেজ জনৈক।
তিনি করলেন কি, যে মালবাহী সব বস্তার আর বাক্সের গায়ে বড়ো, মোটা কালো অক্ষরের লিখে দিলেন,
"KALIKATA"। যে ছিল দক্ষিণের কালিকট, তার ঐশ্বর্যই হল কলিকাতা বা কলকাতা নামের
কারণ। এজন্যই বোধহয় ইংরেজরা মীরজাফরের থেকে জোর করে লিখিয়ে নিলেন আলিনগরের নাম
কলিকাতা করাতে তাঁর আপত্তি নেই।
এরকমই নানা সত্যি মিথ্যে মেশানো কাহিনী মিশে আছে একদিনের
ইংরেজের রাজধানী আর বাংলাদেশের মৃত্তিকায় তৈরি নেটিভদের ভালোবাসার শহর কলকাতার
বুকে। তবুও আজও ভিড়ে ঠাসা গড়িয়াহাটে, বিকেলের পড়ন্ত আলোর মুক্তারাম স্ট্রিট বা
সুকিয়া স্ট্রিটের কোনো এক গলিতে বা সন্ধের হাওয়ায় ময়দান বা প্রিন্সেপ ঘাটে কে
যেন বলে যায়, "কলকাতা আছে সেই
কলকাতাতেই।" সত্যি মিথ্যে যাচাই নাহয় পাঠকই করুক ৷
No comments:
Post a Comment